গোঁজামিল জনগণের চোখ এড়াবে না

গোঁজামিল ও জোড়াতালি দিয়ে কিছুই হয় না, গণতন্ত্র তো নয়ই। জোড়াতালি দিয়ে একমাত্র কাঁথা সেলাই ছাড়া অন্য কিছু সুষ্ঠুভাবে করা যায় না। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ছিল, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার তা প্রবর্তন করেছিল ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন দ্বারা। পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রও ছিল সংসদীয় পদ্ধতির। আড়াইটি বছর নানা রকম গোঁজামিলের মাধ্যমে তা টিকে ছিল। তারপর সামরিক শাসন এসে এক ধাক্কায় সেটুকুও নস্যাৎ করে দেয়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেই সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। জনগণও সংসদীয় গণতন্ত্রকেই গ্রহণ করেছে। গ্রহণ যে করেছে তার প্রমাণ চতুর্থ সংশোধনী থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ছিল, তা থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য মানুষ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে এবং জীবন পর্যন্ত দিয়েছে।

১৯৯১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পাঁচটি সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ছিল। এই ২৭ বছরের দুই বছর ছিল সেনাসমর্থিত বিশেষ সরকার। পদ্ধতির দিক থেকে যা কোনো সংজ্ঞায় পড়ে না। দুটি বছর স্রেফ নষ্ট হয়েছে, কিন্তু তার বাইরে ২৫ বছর কি জাতি নির্বাচিত সংসদীয় সরকারের সদ্ব্যবহার করতে পেরেছে?

৪৭ বছরে জাতি একটি স্থির গণতান্ত্রিক পদ্ধতি গড়ে তুলতে পারেনি। এর জন্য জনগণ দায়ী নয়। জনগণ যখনই স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ পেয়েছে, তারা সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছে। তারা ১৯৫৪ সালে সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। শাসকগোষ্ঠীর তা পছন্দ হয়নি। তারা কায়েমি স্বার্থে নানা গোঁজামিল দেওয়া শুরু করে। তাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাই বিপর্যস্ত হয়ে যায়। সামরিক শাসন আসার পথ তৈরি হয়। জনগণ ১৯৭০–এ সঠিক রায় দেয়। কায়েমি স্বার্থের তা পছন্দ হয়নি। জনগণ ১৯৯১ সালে চেয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র। কিন্তু জনরায় নিয়ে যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাঁরা সোজা পথে না গিয়ে গোঁজামিলের পথ গ্রহণ করলেন। গোঁজামিলের উদ্দেশ্য ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা।

আজ যে জাতি একটা অব্যবস্থাপনা ও গোঁজামিলের মধ্যে পড়েছে, তার জন্য সব নির্বাচিত–অনির্বাচিত বেসামরিক ও সামরিক সরকারই দায়ী। আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে জাতি এক শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। সরকারি জোট ও বিরোধী জোট দুই মেরুতে থাকায় সে অবস্থা। অবশেষে বিরোধী জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মানুষ কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে। তবে পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত হতে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

বিরোধী জোট যদি নির্বাচন বর্জন করত তাহলে বোধ হয় নির্বাচন কমিশন হাঁপ ছেড়ে বাঁচত। কাউকে পাঁজাকোলা করে ধরে এনে নির্বাচন করানো নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। সব দল যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তখন নির্বাচন কমিশনকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। শ্যাম ও কুল দুটো রক্ষা করা চাট্টিখানি কাজ নয়। এবার সব প্রধান দল যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকে তা হবে নির্বাচন কমিশনের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। অগ্নিপরীক্ষা অতি কঠিন জিনিস। প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে অভিযুক্তকে আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে বলা হতো। যদি তার একটি লোমও না পুড়ত তাহলে বোঝা যেত সে নির্দোষ। তবে সে সত্য যুগের ব্যাপার। কলিকালে আগুন অপরাধী ও নিরপরাধ উভয়কেই পোড়ায়।

নির্বাচনের সময় প্রশাসন, পুলিশ প্রভৃতি নির্বাচন কমিশনের অধীন সে কথা কেতাবে আছে এবং বলাও হচ্ছে। বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছে না মানুষ। এই সাংবিধানিক ক্ষমতাটি প্রয়োগের সৎসাহস যদি নির্বাচন কমিশনের না থাকে, তাহলে বিরোধী দল তার ওপরে আস্থা হারাবে।

তবে সব দোষ নন্দ ঘোষকে দিলে বাস্তবতা অস্বীকার করা হয়। আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশনের যতই সাংবিধানিক ক্ষমতা থাকুক, তার সম্পূর্ণ প্রয়োগ সম্ভব নয়। নির্বাচনকালীন সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের পক্ষে শক্ত হওয়া কঠিন। সে অবস্থায় শুধু তাদের দোষ দিলে অবিচার করা হবে।

গণতন্ত্রে মূল খেলোয়াড় হলেন রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মী। তাঁদের আচরণ যদি সংযত না হয় তাহলে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে না। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হওয়ার পর মহানগরীতে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা অনভিপ্রেত। ১৯৫৪ সাল থেকে নির্বাচন দেখে আসছি। এই দৃশ্য কোনো দিন দেখিনি। ১০ ট্রাক ছেলেছোকরা সঙ্গে নিয়ে যানজটের শহরে ফরম কিনতে যাওয়ার মধ্যে কী বাহাদুরি আছে তা বোধগম্য নয়। রাস্তা বন্ধ করে ট্রাকের ওপর যখন নৃত্য চলছে, ধ্বনিত হচ্ছে নেতার নামে মুহুর্মুহু স্লোগান, তখন দেখেছি বেবিট্যাক্সি থেকে নামিয়ে মৃতপ্রায় বাবাকে কোলে নিয়ে ভাই ও বোন হেঁটে যাচ্ছে হাসপাতালে। এ কেমন গণতন্ত্র, কেমন রাজনীতি, কেমন নির্বাচন? সরকারি দলের নেতাদের উচিত ছিল মিছিল করে মনোনয়ন ফরম কিনতে যেন কেউ না আসেন সেই নির্দেশ দেওয়া। হাজারখানেক লোক নিয়ে মনোনয়ন ফরম কিনতে আসার মধ্যে জনপ্রিয়তা প্রমাণিত হয় না। যাঁরা ফরম কেনার সময় এই আচরণ করছেন তাঁরা কেমন জনপ্রতিনিধি হবেন তা মানুষ বোঝে। মনোনয়ন পাওয়ার পর তাঁর এলাকায় যদি কর্মীরা উল্লাস করেন সেটা এক কথা। মহানগরীর লাখ লাখ মানুষকে রাস্তার মধ্যে আটকে রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘন। রাষ্ট্রের কোথাও যেন চেইন অব কমান্ড বলে কিছু নেই।

নির্বাচনী প্রচারণা নির্বাচনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিদ্বন্দ্বীকে আক্রমণ করে বক্তব্য দেওয়া হয়। তবে দায়িত্বজ্ঞানহীন সমালোচনা মানুষ অপছন্দ করে। তাতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কলুষিত হয়। বিরোধী ফ্রন্টের নেতাদের কারোরই বয়স এখন ৬০ বছরের নিচে নয়। তাঁরা অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ।

তাঁদের কাছে মানুষ সংযত কথাবার্তা আশা করে। ছাত্রজীবনে যে রকম উগ্র ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা উত্তপ্ত করেছেন, আজ সে ভাষা শোভন নয়। সম্মানী ব্যক্তি সম্পর্কে, উঁচু পদে অধিষ্ঠিত কারও সম্পর্কে অসুন্দর ও অবমাননাকর শব্দ প্রয়োগ গর্হিত কাজ। সরকার ও বিরোধী দল নির্বাচনে যাচ্ছে, এ অবস্থায় পরিবেশ ভালো রাখার দায়িত্ব বিরোধী দলের নেতাদেরও।

বিরোধী শিবির থেকে বলা হচ্ছে তাদের সংগ্রাম ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’। সে কারণেই তাদের কাঁধে দায়িত্ব বেশি। তাদের কথাবার্তায় ও আচরণে যদি যুক্তি না থাকে, উগ্রতা থাকে বেশি, সৌজন্য প্রকাশের চেয়ে আক্রমণ থাকে বেশি, তবে সাধারণ মানুষের তা ভালো লাগবে না।

মানুষ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করে। এবার সেই সুযোগটা পেয়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। আপসকামিতা ও ব্যক্তিগত লোভ-লালসার কারণে যদি সেই সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে তাঁরা যেমন মানুষের শ্রদ্ধা হারাবেন, তেমনি জাতি ও দেশের হবে অপরিমেয় ক্ষতি। আসন ভাগাভাগি হোক বা যেকোনো ধরনের গোঁজামিল হোক, জনগণের চোখ এড়াবে না। কেউ যদি নিজের জন্য অথবা পুত্র-কন্যার জন্য একটি আসন ভিক্ষা নেওয়াকেই মনে করেন গণতন্ত্র, তবে তা হবে গণতন্ত্রের সঙ্গে দেশবাসীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।

অনেক গোঁজামিল মানুষ দেখেছে। আর দেখতে চায় না। সত্যিকারের জনসেবকেরাই জনপ্রতিনিধি হয়ে সংসদে যাবেন, সেটাই মানুষের প্রত্যাশা। আমরা সাধারণ নাগরিকেরা এমন একটি পার্লামেন্ট দেখতে চাই, যেখানে মোটামুটি এক-তৃতীয়াংশ থাকবেন নারী প্রতিনিধি, এক-তৃতীয়াংশ যুব-নেতৃত্ব এবং এক-তৃতীয়াংশ প্রবীণ অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান। সে সংসদে থাকবে অনগ্রসর সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব। সেলিব্রিটিরা বিচিত্র সুযোগ-সুবিধার অধিকারী। ত্যালা মাথায় তেল না দিয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের অগ্রাধিকার দেওয়া রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সুষম সুন্দর সংসদ গঠিত হবে, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক