ফের ভোট পেছানোর পক্ষে-বিপক্ষে

নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের বৈঠক। ৫ নভেম্বর ২০১৮। প্রথম আলো ফাইল ছবি
নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের বৈঠক। ৫ নভেম্বর ২০১৮। প্রথম আলো ফাইল ছবি

বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের দ্বিতীয় দফা ভোট পেছানোর দাবি তুলতে না তুলতেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা যদিও নাকচ করেছেন; কিন্তু বুধবারে ভোট পেছানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে ঐক্যফ্রন্টের একটি প্রতিনিধিদল ইসিতে যাচ্ছে। অবশ্য একাধিকবার তফসিলে পরিবর্তন আনা আমাদের নির্বাচনী ইতিহাসে বিরল নয়।

সব ছাপিয়ে যেটা বড় হয়ে উঠবে, তা হলো গণভবনে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে যেমন সুন্দর ও শোভন আলোচনা হয়েছে, ইসিতে তারচেয়ে কম কিছু নিশ্চয় কেউ আশা করবে না। গায়েবি মামলার তালিকার বিহিত ব্যবস্থা কিংবা ধরপাকড় বন্ধ করার মূল চাবিকাঠি এখন অনেকটাই ইসির ওপর।

তফসিল ঘোষণার পরে তাই কিছু চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি স্বাধীন ইসির কাছে চলে এসেছে। তফসিলের আগের ইসি আর পরের ইসির মধ্যকার যে পরিবর্তন সংবিধান ও আইন করে দিয়েছে, সেটা এখন ইসির পাঁচ সদস্যকে তাঁদের স্বাধীন কর্ম দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। বিএনপির দাবি অনুযায়ী ভোট এক দফা পিছিয়ে দেওয়ার মনোভাবকে আমরা স্বাগত জানাই।

আমাদের কাছে এই বৈঠক তাই কেবলই ভোট পেছানোর মতো দাবি আদায়ের পর্ব নয়, বরং এটি রেফারির ওপর অনাস্থা কাটিয়ে নতুন করে আস্থা স্থাপনেরও একটি অনুশীলন। রেফারিকে সবাই রেফারির শ্রদ্ধার আসনে দেখতে চায়। এটা মোটেই অসত্য নয় যে শক্ত আইনকানুনের চেয়ে ব্যক্তিত্ব দিয়ে অনেক কিছু জয় করা সম্ভব।

সুতরাং গণভবনের সংলাপ থেকেও প্রাক্‌–নির্বাচনী পরিস্থিতি আরও উচ্চতায় যাবে, সেই আশাবাদ আমাদের থাকবে। কারণ, যে যার অবস্থানে অনড় থেকেও যে পরিস্থিতির বেশ কিছুটা উন্নতি ঘটানো যায়, গণভবন-সংলাপ তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

পুনরায় ভোট পেছাতে হবে—বিএনপি এই মনোভাব এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করেছে। আবার সিইসি এটা নাকচ করেন মঙ্গলবার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ব্রিফিংয়ে। তিনি সেখানে যে কারণ ব্যাখ্যা করেছেন, তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে।

সিইসি বলেন, ‘৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। এরপর আর নির্বাচনের তারিখ পেছানোর কোনো সুযোগ নেই।’ একটি সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেন সুযোগ নেই, তার ব্যাখ্যাও দেন সিইসি। তিনি বলেন, বর্তমান সংসদের মেয়াদপূর্তি হবে ২৮ জানুয়ারি। ৩০ ডিসেম্বর ভোট হলে নতুন সরকার গঠনের জন্য হাতে সময় থাকছে ২৯ দিন। তাঁর কথায়, ‘এই ২৯ দিন কিন্তু খুব বড় কোনো সময় না। নির্বাচনের যে ফলাফলগুলো আসবে, সেগুলোর গেজেট করা, এই ৩০০ আসনের গেজেট করা কিন্তু যা-তা বিষয় না।’

১০ নভেম্বর সহকর্মী হারুন আল রশিদের লেখায় দেখেছি, ইসি নির্বাচনী আইন মেনে প্রথম তফসিলটি ঘোষণা করতে পারেননি। এটা ছোট কি বড় ত্রুটি, সেটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় এটা যে তাঁরা হোমওয়ার্কের অভাবে অযথা আইনবিচ্যুত হয়েছেন। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, ভোট গ্রহণের দিন থেকে ২১ দিনের আগে প্রচারকাজ শুরু করা যাবে না। কিন্তু প্রথম তফসিলে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভোট গ্রহণের দিনের ২৩ দিন আগে থেকে প্রচারকাজ শুরুর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এবারে তারা ব্যবধান ২১ দিনই রেখেছে। কিন্তু আমরা যেটা মনে রাখব, সেটা হলো ওই পরিষ্কার আইন লঙ্ঘনের বিষয় জানতে চাইলে ইসি সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘কমিশনের ক্ষমতা অগাধ। তাঁরা যেভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেভাবেই হবে।’ এটা একটা সাংঘাতিক আপত্তিকর কথন। কারণ, নির্দিষ্ট কোনো আইন থেকে তাদের একচুলও নড়ার সুযোগ নেই। যেখানে আইনে অস্পষ্টতা কিংবা বিশেষ পরিস্থিতি কিছু দাবি করে, সেটা ভিন্ন কথা। তাই ওই আইন লঙ্ঘন ইসির কম যোগ্যতানির্দেশক কি না, সেই প্রশ্ন কেউ তুলতে পারেন।

যা হোক, সিইসির ব্যাখ্যায় আসি। তিনি সংসদ গঠনের পরিবর্তে সরকার গঠনের প্রশ্ন তুলেছেন। ২৮ জানুয়ারি সংসদ আপনা–আপনি ভেঙে যাবে। একটি সাধারণ নির্বাচনের পরে সংবিধানমতে মূল চিন্তাটা সংসদ গঠন নিয়ে। সংসদ নতুন সরকার দেবে। নতুন সরকার সংসদ দেবে না।

একটি সাধারণ নির্বাচনের পরে সরকার গঠনের বল থাকবে রাষ্ট্রপতির কোর্টে। কিন্তু ইসিকে নজর রাখতে হবে সংসদের ফলাফল প্রকাশে। কারণ সংবিধান বলেছে, ‘কোন সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হইবার ত্রিশ দিনের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য সংসদ আহ্বান করা হইবে। আর রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে।’

সিইসি নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘এই ২৯ দিন কিন্তু খুব বড় কোনো সময় না। নির্বাচনের যে ফলাফলগুলো আসবে সেগুলোর গেজেট করা, এই ৩০০ আসনের গেজেট করা কিন্তু যা-তা বিষয় না।’ ভোটের তারিখ দরকার হলে আরও না পেছাতে এই যুক্তি সবল নয়। কারণ, তিনি অনেক সময় নষ্ট করেছেন।

এ নিয়ে আমরা কথা বলি নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমিন টুলির সঙ্গে। টানা ৩২ বছর ইসিতে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মিজ টুলি সাবেক সিইসি বিচারপতি আবদুর রউফের একটি উক্তি স্মরণ করেন। বিচারপতি আবদুর রউফ বলেছিলেন, ইসি হলো একটি পোস্ট বক্স। এর অর্থ হলো ফলাফল ঘোষণার এখতিয়ার রিটার্নিং কর্মকর্তার। গণনার পরপরই তিনি তা একটি ‘পাবলিক নোটিশে’ জানিয়ে দেবেন। এই জানানোটাই প্রকারান্তরে ফলাফল ঘোষণার বাস্তব শর্ত পূরণ করে। আর পরে সেই ফলই গেজেটে প্রকাশের কাজ ইসি করে থাকে।

নির্বাচনী আইনের কোথাও অবশ্য বেসরকারি ফলাফল, পাবলিক নোটিশ জারি এবং গেজেট প্রকাশের মধ্যে কত ঘণ্টা বা দিনের ফারাক থাকবে, সে বিষয়ে কিছু বলা নেই।

জেসমিন টুলির সঙ্গে আমরা একমত হই, এখানে মূল চিঠি (ফল ঘোষক) লেখক হলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। আর সেটা পোস্ট বা রাষ্ট্র করার দায় ইসির। মিজ টুলির যুক্তি: ‘আরপিওর ৩৯ (৪) ধারা যেহেতু বলেছে, ঘোষিত প্রার্থীর নাম ইসি গেজেটে প্রকাশ করবে। কথাটা “শ্যাল” দিয়ে বলা আছে। সুতরাং রিটার্নিং কর্মকর্তার পাবলিক নোটিশটি দুই লাইনে টাইপ করে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা ছাড়া ইসির আর কোনো কাজ নেই।’

ওইরূপ পাবলিক নোটিশ জারির আগে যদি প্রার্থী বা নির্বাচনী এজেন্ট লিখিতভাবে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করেন কিংবা ইসি অনুরূপ নির্দেশ না দেন, তাহলে রিটার্নিং কর্মকর্তা কোনো ভোটকেন্দ্রের বৈধ ব্যালট পুনর্গণনাও করতে পারবেন না।

সুতরাং পাবলিক নোটিশটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে ব্যবহারিক অর্থে একটি ধারণা জনপ্রিয়। তা হলো গেজেট না করলে সেটা আর সরকারি ফল হলো না।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরর সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন যে বিদেশিরা দেখতে আসবে বলে ভোট পেছানোর দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, বিদেশিদের ২০১৪ সালের নির্বাচনটি মানা বা না মানার সনদের ওপর কাজের কাজ কিছু হয়নি। মানুষের হৃদয়ে গত সংসদের জায়গা ঠুনকো হয়েই থাকবে।

যদিও এটা বাস্তবতা যে ২৫ ডিসেম্বরে বড়দিনের ছুটিতে গোটা পাশ্চাত্য জগৎ লম্বা অবকাশে যায়, ঠিক তখন নির্বাচন করলে বিদেশি সাংবাদিকদের রাডারেও হয়তো বাংলাদেশের নির্বাচনটি অপেক্ষাকৃত কম ধরা পড়বে। অপ্রিয় বাস্তবতা এটাও যে ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী দল বিদেশিদের যথাক্রমে ভীষণ অপছন্দ ও ভীষণ পছন্দ করে থাকে। বিএনপির মতে, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নজর এড়িয়ে ভোট চুরি করতে চায় সরকার। কিন্তু আমরা জানি, ইইউয়ের মতো বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা অনেক আগেই বলেছে, তারা বড় আকারে আসবে না। একজন ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূত আমাকে বলেছেন, ইইউ একটি ছোট টেকনিক্যাল মনিটরিং টিম পাঠাবে, তবে তারা প্রকাশ্যে কোনো রিপোর্টই প্রকাশ করবে না। জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তাও বললেন, তাদেরও খুব বড় নজর থাকবে না। বিএনপির উচিত হবে আমজনতার পর্যবেক্ষণের ওপরই বেশি আস্থাশীল থাকা।

তবে সিইসি যখন বলেন ‘জানুয়ারিতে (ইজতেমা ১১ তারিখে স্থির আছে, তবে এটা পেছাতে পারে) বিশ্ব ইজতেমার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লম্বা সময় ব্যস্ত থাকতে হয় বলে সে সময় নির্বাচন করা কঠিন’, তখন আবারও এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছে প্রত্যাশিত হয়ে ওঠে যে এ রকম ফ্যাক্টর তাঁর চিন্তায় কখন থেকে ঘূর্ণন তৈরি করছে?

পাঁচ বছর আগে দশম সংসদের প্রথম বৈঠক বসার তারিখেই সবার জানা ছিল ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারিতে সংসদ ভেঙে যাবে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে সংলাপের সময় সিইসি বলেছিলেন, ‘সহায়ক সরকার, সংসদ ভেঙে দেওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের ওপর চাপ বা বাধ্য করার সুযোগ নেই।’

তাই আমরা পুনরায় জোর দিয়ে বলব, তিনি এটা এড়াতে পারেন না যে তিনি ঠিক কখন থেকে সংসদ রেখে না রেখে নির্বাচন করা হবে, সে বিষয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন। অথচ এটি একটি কোটি টাকা দামের প্রশ্ন। এই বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। ধরে নিই, প্রধানমন্ত্রী দ্বারা তিনি আগাম অবহিত না হলে তিনি ধরে নেবেন যে সংসদ রেখেই করা হবে। এই যুক্তি মানলে এটাও মানতে হবে যে সিইসি নতুন সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ২৮ অক্টোবর থেকে পরবর্তী যেকোনো দিন ধার্য করতে পারতেন। তফসিল ঘোষণা ও ভোট গ্রহণের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ দিন সময় রেখে নির্বাচন করা হয়। সেই হিসাবে তিনি আগস্ট-সেপ্টেম্বরে তফসিল ঘোষণায় তৎপর হওয়ার বিষয়ে সাংবিধানিকভাবে এখতিয়ারপ্রাপ্ত ছিলেন। সেটা তিনি কেন করেননি? ভোটের ফলাফল ঘোষণার এক মাসের মধ্যে সংসদ ডাকার অপরিহার্যতা আছে। আর এ কারণে অক্টোবর বা নভেম্বরে ভোট করলে সংসদের মেয়াদ পুরা করার বিষয়টি নিয়ে একটা বাড়তি জটিলতা তৈরি হতো। কিন্তু তিনি তো রেফারি। তাই কোনো একটি পক্ষের (সরকারি দলের) হয়ে সেটা তো স্বপ্রণোদিতভাবে বা সুয়োমোটো তার দেখার বিষয় ছিল না। 

৮ নভেম্বর তিনি তাঁর ভাষণে জাতিকে শুনিয়েছেন, ‘২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ইতিমধ্যে নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়ে গিয়েছে। কমিশনারগণ সংবিধানের আলোকে সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করার শপথ নিয়েছেন এবং তাতে তাঁরা নিবিষ্ট রয়েছেন।’ এই বিবৃতিতে আংশিক এবং খণ্ডিত সত্যের প্রতিফলন ঘটেছে। কেউ একে অর্ধসত্য বা অসম্পূর্ণ সত্য বলতে পারেন। তিনি ব্যাখ্যা করেননি, কেন তিনি ২৮ অক্টোবরের তারিখ, অর্থাৎ ৯০ দিনের ক্ষণগণনার শুরুর বিষয়ে নীরব থেকেছেন, কেন তিনি ১৯ নভেম্বরের পরিবর্তে ১৯ আগস্ট, ১৯ সেপ্টেম্বর বা ১৯ অক্টোবরে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ঘোষণার সাংবিধানিক বিকল্পগুলো প্রধান দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ হাতছাড়া করলেন, তা তাঁর পরিষ্কার করা সমীচীন।

এসব প্রশ্নের একটা কৈফিয়ত একদিন তাঁকে দিতে হবে। এই মুহূর্তে আমরা তাঁর সাফল্য কামনা করব। আশা করব, তিনি যে ‘নতুন ইতিহাস’ তৈরির অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, তা গণমুখী হবে এবং তাতে তিনি সফল হবেন।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]