রাজনৈতিক সহিংসতা

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও রাষ্ট্র কখনো তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ভাবেনি। যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধনকৃত অলাভজনক স্বাধীন সংগঠন আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্টের (এসিএলইডি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন আমাদের এই দায়বোধের ঘাটতিই স্মরণ করিয়ে দিল।

ওই প্রতিবেদনের মতে, বর্তমান সরকার সমাজের দুস্থ ও দুর্গতদের বিশেষ ভাতা ও সহায়তাদানে প্রশংসনীয় বহু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ২০১০ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত দেশে সহিংসতাসহ প্রায় ১৪ হাজার ঘটনা ঘটেছে এবং প্রতিবছর সহিংসতার শিকার হওয়া সাধারণ মানুষের হার ১৫ থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই মানুষগুলো সরকারি সহায়তার বাইরে রয়ে গেছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে রাজনীতি হয়, কিন্তু তাদের দুর্দশা ঘোচাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আন্দোলনে তাঁদের আত্মত্যাগকেও যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। ১৯৮৭ সালে শহীদ নূর হোসেনের বীরোচিত আত্মদান তাঁকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত করেছে। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে সেই স্বৈরাচারী সাবেক শাসকের সহযোগীরা সেই নূর হোসেনকে নিয়ে কটাক্ষ করতেও দ্বিধা করছে না। 

ওই প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর রাজনৈতিক সহিংসতার তুলনামূলক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, যাতে দেখা যায় বাংলাদেশেই রাজনৈতিক বৈরিতা ও বিরোধে সবচেয়ে বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরপর রয়েছে পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বৈরিতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে। সেসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ কেউ ও তাদের পরিবার সহায়তা পেলেও তা কোনো আইনি কাঠামোর আওতায় হয়নি।

বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহিংসতা ছাড়াও একই দলের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপের সংঘাত-সংঘর্ষে বাংলাদেশে অনেক নিরীহ ও সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জীবন দিতে হয়। এ ধরনের একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ মোহাম্মদপুরের আদাবরের ঘটনা। সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুই শ্রমজীবী তরুণ মারা যান। এই হত্যার দায় কে নেবে? কেউ এর জন্য শাস্তি ভোগ করবে এমন আশা করাও কঠিন। ক্ষমতার রাজনীতি শ্রমজীবী মানুষকে ব্যবহার করে কিন্তু তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কোনো দায় নেয় না।   

আমরা মনে করি, রাজনৈতিক সহিংসতায় যারা হতাহত এবং যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রের তরফে তাদের সাহায্য প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যাদের কারণে সংশ্লিষ্টরা সহিংসতার শিকার হলো, তাদের কাছ থেকেও ক্ষতিপূরণ আদায় করা যেতে পারে। এ বিষয়ে তাজরীন ফ্যাশনসের দুর্ঘটনার জন্য কারখানারা মালিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদালতের নির্দেশও উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধে রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারানো বা কারও না কারও পঙ্গু হওয়ার মতো পরিবারগুলোর সঠিক তালিকাও তৈরি হওয়া উচিত। বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে সত্য, কিন্তু আমরা মনে করি একে একটি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনা প্রয়োজন। রাজনীতির কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে; কিন্তু রাষ্ট্র তাদের প্রতি কোনো দায়বোধ করবে না, এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজন যে আমরা এই রুগ্‌ণ রাজনৈতিক বৃত্ত ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাই কি না।