গোঁজামিলের নির্বাচনী তফসিল

গত দু–একটা লেখায় সংসদের মেয়াদ কত, সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে আমরা কিছু আলোচনা করেছি। কিন্তু গোঁজামিল কাটছে না। গোঁজামিল কার, সেই প্রশ্নের উত্তরে পরে আসব।

এত দিনে পাঠকমাত্রই জানেন যে সংসদের মেয়াদ পূরণ করতে সংসদকে মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত বহাল থাকতে হবে। অথবা প্রধানমন্ত্রীর উপদেশে রাষ্ট্রপতি মেয়াদ পূর্তির আগেই সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করলে নির্বাচনের দিন–তারিখ এক রকম, আর মেয়াদ পূর্তির আগে সংসদ ভেঙে দিলে নির্বাচনের দিন–তারিখ হবে অন্য রকম। প্রধানমন্ত্রী এই দুই বিকল্পের একটি বেছে নেবেন। আমরা জানি, বর্তমান দশম সংসদ তার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকছে। এর ফলে নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন তফসিল–সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ হচ্ছে এই সংসদ পূর্ণ মেয়াদকাল শেষ করবে, সেই ধারণা থেকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশন এটা জানল কীভাবে? আমাদের আমজনতার মতো সরকারি দলের মন্ত্রী-নেতাদের বক্তৃতা থেকে নাকি কোনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের (মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্পিকারের সংসদ-সচিবালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রভৃতি) কাছ থেকে লিখিত চিঠি বা অন্য কোনো ধরনের যোগাযোগের মাধ্যমে? আমজনতার মতো সংবাদমাধ্যম থেকে ‘খবরটি নিশ্চিত করে’ তার ভিত্তিতে নাকি উপরোল্লিখিত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দিষ্টভাবে তথ্যপ্রাপ্ত হয়ে? বলা বাহুল্য, সরকার বা কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশনকে মেয়াদ পূর্তির ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে অবহিত করে থাকলে তার একটা আইনগত পরিণতি হবে; অর্থাৎ এখন ২৮ জানুয়ারির আগে প্রধানমন্ত্রীর উপদেশে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিলে অনেক ধরনের ‘বেকায়দা’ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

২.
এখন আসি আরেকটি গোঁজামিলের ইস্যুতে। নির্বাচন এবং নির্বাচন-উত্তর সংসদ কখন বসবে, সে ব্যাপারে অতীতে আমরা একবার ঝামেলায় পড়েছিলাম এবং সেই ঝামেলা মেটাতে সংবিধান সংশোধন পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচিত পঞ্চম সংসদের নির্বাচনের পর ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ সালে পাস হওয়া সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে সময়ের গোঁজামিলের কারণে সংসদের সাংবিধানিক বৈধতা অক্ষুণ্ন রাখতে একটা ‘জায়েজ’ করা বিধান যোগ করতে হয়। দ্বাদশ সংশোধনীতে বলতে হয়েছিল, ওই সংসদটা সংবিধানসম্মত বলে ধরে নেওয়া হবে। সংবিধান না মেনে বা না বুঝে কিছু করা এবং পরে ‘জায়েজ করা সংশোধনী’ পাস করা আমাদের ভীষণ বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

না জেনে করেছেন নাকি না বুঝে, কোনোটাই হলফ করে বলতে পারব না, তবে নির্বাচন কমিশন ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ স্থির করে একটা ঘোষণা দিয়েছিল ৮ নভেম্বর। তাদের সেই ঘোষণা বা তফসিল অনুযায়ী ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে প্রথা অনুযায়ী সম্ভবত ২৫ ডিসেম্বর ফলাফল ঘোষিত হতো। সে ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭২(২) অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী নবনির্বাচিত ১১তম সংসদের প্রথম অধিবেশন ওই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ থেকে এক মাসের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হওয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকত; অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হওয়ার কারণে ২৪ জানুয়ারি ২০১৯–এর মধ্যে ১১তম সংসদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার সাংবিধানিক আবশ্যকতা তৈরি হতো। তখন সমস্যাটা হতো সংবিধানের ১২৩(৩)–এর শর্তাংশে ঘোষিত অন্য একটি বিধানের কারণে। সেখানে বলা আছে, মেয়াদ পূর্তির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে যে সংসদ নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনে নির্বাচিত সাংসদেরা বহাল থাকা সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শপথ নিতে পারবেন না। তাহলে দাঁড়াচ্ছে কী? একদিকে নতুন সাংসদদের সংসদে বসতে হবে ২৪ জানুয়ারি ২০১৯–এর মধ্যে; অন্যদিকে বিদ্যমান সংসদ বহাল থাকবে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। সৃষ্ট গোঁজামিল এড়াতে ১১তম সংসদকে তাদের প্রথম অধিবেশনেই অথবা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আরেকটি সংবিধান সংশোধনী করে হয়তো নিজেদের ‘জায়েজ’ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিত। অথবা অন্য কূটকৌশলের আশ্রয় নেওয়া যেত; যেমন ২০ জানুয়ারি ২০১৯ নাগাদ প্রধানমন্ত্রীর উপদেশে রাষ্ট্রপতি দশম সংসদ ভেঙে দিয়ে ২৩ বা ২৪ জানুয়ারি ১১তম সংসদের অধিবেশন আহ্বান করতেন। সেটা করলে অন্য আরেকটি নতুন ঝামেলা তৈরি হতো। কারণ আগেই বলেছি, দশম সংসদ পূর্ণ মেয়াদ বহাল থাকবে সেই সিদ্ধান্ত যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অবহিত হয়ে মেয়াদ পূর্তির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন ২৩ ডিসেম্বর তারিখ ঘোষণ করেছিল। একবার সরকার বলবে সংসদ থাকবে পূর্ণ মেয়াদ, আরেকবার সিদ্ধান্ত নেবে ১৫ বা ২০ জানুয়ারি মেয়াদ পূর্তির আগেই সংসদ ভেঙে দেবে—সবই গোঁজামিল।

স্পষ্টতই নির্বাচন কমিশন সংবিধানের ৭২(২) অনুচ্ছেদের সঙ্গে ১২৩(৩) অনুচ্ছেদের শর্তাংশ একসঙ্গে পড়ে তাদের করণীয় নির্ধারণ করেনি।

৩.
রাজনৈতিক দলগুলো চেয়েছিল নির্বাচন পেছাতে। আর টেলিভিশনে দেখলাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, নির্বাচন এক বা দুই মাস পিছিয়ে দিলেও তাঁদের আপত্তি নেই (আশা করি তাঁর বক্তব্যটা আমি সঠিক বুঝতে পেরেছি)। আর নির্বাচন কমিশনার করলেন কী, তাঁদের প্রচণ্ড মহানুভবতায় নির্বাচন পেছালেন সর্বসাকল্যে সাত দিন। সাংবিধানিক গোঁজামিল তো দূর হলো না। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন হলে প্রথা অনুযায়ী আমরা ফলাফল প্রত্যাশা করব ১ জানুয়ারি। ঝুটঝামেলার কারণে দুই-চারটা আসনে নির্বাচন স্থগিত হতে পারে, সেগুলোর ফলাফল বাদ দিয়ে ১ জানুয়ারি ফলাফল ঘোষিত হলে ৭২(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১১তম সংসদের প্রথম অধিবেশন হতে হবে ৩০ জানুয়ারি। ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে দশম সংসদের মেয়াদ পূর্তি হওয়ার পর ১ দিন মাঝে রেখে নতুন সংসদকে বসতে হবে ৩০ জানুয়ারি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নির্বাচিত নতুন সাংসদদের সংসদ ভবনে হাজির হওয়ার জন্য কী দৌড়ঝাঁপটাই না দিতে হবে। বেচারা সংসদ সচিবালয় পুরোনোদের বিদায় দিয়ে নতুনদের বরণ করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য সময় পাবে মাত্র কয়েক ঘণ্টা।

আবার কূটকৌশলের আশ্রয় নিই। নির্বাচন কমিশন হয়তো ফলাফল ঘোষণা হাতে ধরে রাখবে। ১ জানুয়ারির পরিবর্তে ৭ বা ১০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণা করবে। তাহলে নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনের জন্য সময় হয়তো পাওয়া যাবে ৬ বা ৯ ফেব্রুয়ারিতক। গোঁজামিল, কূটকৌশল, জায়েজ করা, ইত্যাদি ইত্যাদিই কি এখন সহজাত অভ্যাসে পরিণত হলো? নাকি তাঁরা জানেন না, বোঝেন না?

৪.
গোঁজামিল বা গোঁজামিলের সংখ্যা এড়াতে ৩০ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ১৫ বা ২০ জানুয়ারি নাগাদ নির্বাচনের নতুন তারিখ নির্ধারণ করা অত্যাবশ্যক। আগেই উল্লেখ করেছি, এত দিন পেছালে সরকারি দলের আপত্তি নেই। ঐক্যফ্রন্টও বলেছে ১ মাস পেছাতে। ছোটখাটো দুই-চারটা দল এদিক–সেদিক দাবি করতেই পারে, কিন্তু নির্বাচনের মাঠে মুখ্য খেলোয়াড় এই দুই পক্ষ। আর নির্বাচন কমিশন নির্বাচন-খেলার আম্পায়ার বা রেফারি। কোনো পক্ষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করে নিরপেক্ষ থাকাই নির্বাচন কমিশনের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। নির্বাচনের তারিখ আরও কিছুদিন পিছিয়ে দিলে আপনাদের প্রতি জনগণের আস্থা অনেক বাড়বে। পরবর্তী সময়ে আপনারা ইতিহাসের সুনজরে থাকবেন। অন্যথায় চিরতরে বদনামের ভাগীদার হবেন, হয়ে থাকবেন গোঁজামিলের নির্বাচন কমিশন।

ড. শাহদীন মালিক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক