মাঠ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার সংস্কার

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব অনেকটাই কেটেছে। যাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছেন, তাঁদের বিবেচনার জন্য কিছু বিষয় তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি। বিষয়গুলো অতীতে নানা দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে নানাভাবে এসেছে। কিন্তু অর্থবহ কিছু করা হয়নি। নির্বাচন উপলক্ষে বিষয়গুলো আবারও সামনে আনা উচিত। বিষয়গুলো দুটি প্রধান অংশে ভাগ করে করণীয়গুলোর একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দাঁড় করানো হলো। প্রথমে মাঠ প্রশাসন সংস্কার বিষয়ে আলোকপাত করা হবে। তারপর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামো ও আইনের সংস্কার এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন সংস্কারবিষয়ক প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে পারে।

মাঠ প্রশাসন বিষয়ে প্রথমে বলতে হয়, ভারত উপমহাদেশে বিভাগ, জেলা, মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত যে মাঠ প্রশাসনকাঠামো রয়েছে, তা মোটের ওপর ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে উন্মেষ ও বিকাশ লাভ করে। পাকিস্তানের ২৪ বছর ও বাংলাদেশের ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এর মূল কাঠামো ও কার্যপ্রণালিতে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ঔপনিবেশিক কাঠামোতে যা ছিল, বস্তুত এখনো তা–ই আছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো মাঠ প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল না। ১৯৮০ দশক থেকে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়, তা দৃশ্যত মৌলিক ও ইতিবাচক মনে হলেও অবশেষে নেতিবাচকতায় পর্যবসিত হয়। যেমন মান উন্নীত থানা, উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদ সৃষ্টি, মহকুমা স্তরের প্রশাসনিক এককের বিলুপ্তি, জেলা ও বিভাগের সংখ্যা বৃদ্ধি। একপর্যায়ে বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ইত্যাদির সংখ্যা বৃদ্ধি একটি নতুন মাত্রা পেয়ে যায়। এককের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা, সরকারের রাজস্ব ব্যয় ও জমি হুকুমদখল করে সুবৃহৎ সরকারি স্থাপনার সংখ্যা। কিন্তু জনসেবার গুণ ও মান আনুপাতিক হারে বাড়েনি; বরং জনজবাবদিহি ও জনসম্পৃক্ততা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। জনপ্রশাসন ও গণপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা, কার্যক্রম ও অর্থায়নের সীমানা-পরিধি-সমন্বয়-সহযোগিতা একটি বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পড়ে।

মাঠ প্রশাসনে আমলা-কামলা বা সাধারণ ও বিশেষজ্ঞ দ্বন্দ্ব, একই প্রকৃতির কাজের জন্য একাধিক সরকারি দপ্তর, তাদের মধ্যে ক্ষমতা, অর্থ ও কাজের দ্বন্দ্ব, পদমর্যাদাগত দ্বন্দ্ব ইত্যাদি দিন দিন প্রকটতর হতে থাকে। প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও কৃষিবিদেরা বিসিএস সাধারণ ক্যাডারের কর্তৃত্ব সহজে মানতে চান না। কিন্তু সচিবালয় প্রশাসন সব সময়ই সমন্বয়ের নামে সাধারণ প্রশাসনিক কর্মকর্তার হাতে অন্য সবার নিয়ন্ত্রণ রেখেই দেয়। উপজেলা থেকে নিচের দিকে বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে (প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ) ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ সরকারি বেতন-ভাতা-পেনশনধারী জনবল রয়েছে। জনবল ও আর্থিকসংশ্লিষ্টতার পরিমাণে বা পরিমাপে সেবাপ্রাপ্তির কোনো মূল্যায়ন নেই। একটি উপজেলায় একই মন্ত্রণালয়ের বা ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের একাধিক দপ্তর একই ধরনের কাজ করে যাচ্ছে। যেমন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সমান্তরালভাবে চলছে। একই মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন বিভাগের সমবায় সংগঠনের জন্যও দুটি দপ্তর—যথা সমবায় অধিদপ্তর ও পল্লী উন্নয়ন বোর্ড পৃথকভাবে কাজ করে। সমাজসেবা, যুব, মহিলা, শিশু, আনসার-ভিডিপি, বিআরডিবি প্রভৃতি দপ্তরের কাজের মধ্যে মৌলিক কোনো তফাত নেই। তারা একই কাজ ভিন্ন ভিন্ন নামে বা প্রকল্পের অধীনে করে থাকে। অনেকের অর্থবহ কাজ না থাকায় ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নানা কাজে বেগার খাটে। অনেকে কর্মস্থলে প্রায় অনুপস্থিত থাকেন। অনেক দপ্তরে পদায়িত কর্মকর্তাই নেই। অন্য উপজেলার কর্মকর্তা চলতি বা ভারপ্রাপ্ত হিসেবে কাজ চালান। এ ব্যবস্থা মোটমুটি নিয়মে পরিণত হয়েছে।

উপজেলায় একটি সুবিধা হচ্ছে, উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা সবাই একই ক্যাম্পাসে অফিস করেন। উপজেলা পরিষদের নামকাওয়াস্তে একটি নজরদারিও আছে। জেলায় তা–ও নেই। জেলার সরকারি দপ্তরগুলো জেলা শহরজুড়ে বিস্তৃত। জেলা পরিষদের সঙ্গে যেমন জেলার উন্নয়ন দপ্তরগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই, তেমনি ডেপুটি কমিশনারকে ‘জেলা প্রশাসক’ বলা হলেও জেলার সার্বিক প্রশাসনে সে দপ্তরের ভূমিকা অত্যন্ত গৌণ। জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভা হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। ওই সভায় সবাই আসেন না। জেলা পরিষদের নির্বাচিত সভাপতি থাকলেও এ ক্ষেত্রে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সর্বশেষ পরিপত্র অনুযায়ী, জেলা প্রশাসকের কর্মতালিকায় ৫০২টি কাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জেলাভেদে পার্থক্য হলেও একজন জেলা প্রশাসক কমবেশি ৯০–১০০টি কমিটির সভাপতি। তা ছাড়া, জেলার সব সরকারি ভূ-সম্পত্তির কার্যত মালিক জেলা প্রশাসক। ভূমি রাজস্ব আদায় ও জমির রেকর্ড তাঁর জিম্মায়। এই ভূ-সম্পত্তির মধ্যে খাল–বিল, নদী–নালা, হাওর–বাঁওড় ইত্যাদি আছে। এ দেশে জলাভূমি বেদখল, অপদখল বা ভূমিদস্যুতা ইত্যাদি সর্বজনবিদিত। জেলা প্রশাসকেরা সরকারের ভূ-সম্পদ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেননি। এটিই তো তাঁদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হওয়ার কথা। দেশের প্রতিটি জেলায় কী পরিমাণ সরকারি জমি কখন, কীভাবে বেহাত হয়েছে, তার মূল্যায়ন দরকার এবং অপদখল-বেদখল থেকে সরকারি জমির সুরক্ষা একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। জেলা প্রশাসক বা ডেপুটি কমিশনার একাধারে ভূমি মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ, খাদ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নির্দেশ গ্রহণ করেন। এ ছাড়া অন্যান্য উন্নয়ন, সেবা ও রেগুলেটরি বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও সংযোগ রক্ষা করে থাকেন। তা ছাড়া, জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কার্যাবলির একটা মুখ্য দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের ওপরই বর্তায়। এভাবে দীর্ঘকাল ধরে ‘জেলা প্রশাসন’ নামের এ কাঠামোটি সর্বকাজের কাজি হয়ে সুনির্দিষ্টতা, সঠিক কার্যকারিতা ও মনঃসংযোগবিন্দু হারিয়ে ফেলেছে। তাই জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদ এবং জেলার সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রমগুলোর ভূমিকা, কার্যক্রম, পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমন্বয় ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। কর্মবণ্টন সঠিক ও সুষম এবং জবাবদিহি সুনির্দিষ্ট হওয়া দরকার।

অন্যদিকে কোনো রকম কমিটি বা কমিশন ছাড়াই দেশে বিভাগের সংখ্যা বেড়েই চলছে। ভারতে প্রায় ১৭টি রাজ্যে বিভাগীয় স্তরটি নেই। ব্রিটিশ আমলে দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থার কারণে ঔপনিবেশিক জেলা প্রশাসনকে তদারকির জন্য বিভাগীয় কমিশনারের পদটি সৃষ্টি করা। ১৯৪০–এর দিকে গঠিত ‘রয়্যাল কমিশন অন ডিসেন্ট্রালাইজেশন’ প্রশাসনিক একক হিসেবে ‘বিভাগ’ বিলুপ্তির সুপারিশ করে। ইতিমধ্যে সড়ক, রেল ও আকাশপথসহ সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। তাই এ যুগে আর বিভাগের প্রয়োজন নেই। অথচ এ দেশে এই অপ্রয়োজনীয় প্রশাসনিক স্তরের জন্য রাজনৈতিক আগ্রহ আকাশচুম্বী।

মাঠ প্রশাসনকে দক্ষ, লক্ষ্যাভিমুখী, সুনির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ করা প্রয়োজন। ‘সকল কাজের কাজি’ ধরনের প্রশাসকের যুগ বাসি হয়েছে। এখন কাজ হবে সুনির্দিষ্ট, ফলাফল পরিমাপযোগ্য এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হবে দ্রুত ও ব্যয়সাশ্রয়ী। এ ছাড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করা প্রয়োজন তা হলো, প্রশাসন ও রাজনীতির পৃথক্করণ। কোনো পর্যায়ের সরকারি কর্মচারী কোনো স্থানীয় বা জাতীয় রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীর কাছ থেকে কোনো নির্দেশ গ্রহণ করবেন না। সরকারি কর্মচারীরাও রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কোনো বিশেষ অনুগ্রহ চাইতে পারবেন না। সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি চাকরিবিধি অনুযায়ীই হবে। সরকারি কর্মচারীদের দলসংশ্লিষ্টতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। দলীয় রাজনীতির হস্তক্ষেপ থেকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ব্রিটিশ শাসনের ৭০ বছর পরও মাঠ প্রশাসনকাঠামো প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কার না হওয়ায় তা বহু ক্ষেত্রে ব্যয়বহুল, কালক্ষেপণকারী, অপচয়ী ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তার ওপর রাজনীতি ও প্রশাসনের সীমারেখা মুছে যাওয়ায় নিরপেক্ষ ও পেশাদার প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। বেসরকারি খাতের বিকাশের কারণে সরকারি বহু দপ্তরের কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যেমন ডাক বিভাগ, বিএডিসি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজসেবা, জনশক্তি উন্নয়ন, নারী উন্নয়নসহ অনেকের সেবা কার্যক্রমে বেসরকারি খাতের প্রবল প্রতিযোগিতা। এখানে অসুস্থ প্রতিযোগিতার বদলে সুস্থ সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

জাতীয় ও স্থানীয় মাঠপর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই কিছু দপ্তর ও বিভাগের বিলুপ্তি বা একত্রীকরণ প্রয়োজন। যেমন একই মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দুটি পৃথক অধিদপ্তরের বিষয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ব্রিটিশ সময়ের দপ্তর, এলজিইডি ১৯৮০–এর দশকে সৃষ্ট। একইভাবে সমবায় অধিদপ্তর ১৯০৪ সালের প্রতিষ্ঠান আর বিআরডিবি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে সৃষ্টি করা হয়। তাদের কাজের যে ধরন, তাতে পৃথক দপ্তরের প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এখন সময় হয়েছে এগুলোর সুষমভাবে একত্রীকরণের। কিছু সরকারি দপ্তর বিলুপ্ত বা অন্যান্য দপ্তরের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়। আর যেসব বিষয়ে বেসরকারি খাত অধিক দক্ষ ও ব্যয়সাশ্রয়ী, সেসব খাতে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার সঠিক ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। তবে এসব সিদ্ধান্ত কখনো নির্বাহী আদেশে হওয়া উচিত নয়। তাই এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে এসব বিষয় বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হোক। নির্বাচনী অঙ্গীকারে মাঠ প্রশাসন সংস্কারের অ্যাজেন্ডা স্থান পাক। নির্বাচনের পর একটি উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে মাঠ প্রশাসন সংস্কারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হোক।

ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ
[email protected]