আচরণবিধি পরিবর্তনের কী হলো?

একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ১৬ অক্টোবর আচরণবিধি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা হলো তাকে ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ হিসেবেই বিবেচনা করতে হচ্ছে। সিইসি তখন বলেছিলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পর জানতে পারব সরকারের অবস্থান কী থাকবে, এমপিদের অবস্থান কী থাকবে।… আমরা দেখি [সরকার] এমপিদের কীভাবে রাখে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আচরণবিধির কিছু কিছু পরিবর্তনের উদ্যোগ নেব।’ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর)। এরপর কিন্তু তঁাকে আমরা এ বিষয়ে কোনো অর্থবহ ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখলাম না। অতীতে আমরা নানামুখী বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নির্বাচন করেছি। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন করেছেন, আবার তার অব্যবহিত পরেই ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হলেও তাঁকে এখন পর্যন্ত কোনো নিরপেক্ষ ও সাহসী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

তাঁর নেতৃত্বাধীন কমিশন যে স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা, বাক্‌স্বাধীনতার অনুশীলন এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তার প্রমাণ আমরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে পরিষ্কার দেখতে পাই। আমরা আজ আচরণবিধি নিয়ে কথা বলব। তবে এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ড. শাহদীন মালিকের তোলা একটি অসম্ভব জরুরি প্রশ্ন। তিনি গতকাল তাঁর লেখায় প্রশ্ন তুলেছেন, নির্বাচন সংসদ রেখে না ভেঙে করা হবে, তা কীভাবে জানল ইসি। আমরা জানি, সরকারের সঙ্গে এ রকম কোনো আলোচনা ইসির ঘটেনি। ঘটে থাকলে তা কোনোক্রমেই গোপনীয় বিষয় হতে পারে না। শুধু এই একটি প্রশ্নের উত্তর যদি সিইসি বা তঁার কমিশনাররা জাতিকে অবহিত করেন, তাহলে আমরা খুবই উপকৃত হব।

ড. মালিক লিখেছেন, ‘সরকার বা কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশনকে মেয়াদ পূর্তির ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে অবহিত করে থাকলে তার একটা আইনগত পরিণতি হবে; অর্থাৎ এখন ২৮ জানুয়ারির আগে প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিলে অনেক ধরনের “বেকায়দা” পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।’ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ড. আকবর আলি খান একটি উদ্বেগজনক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। আমরা তার সদুত্তর পাইনি। ড. খানের আশঙ্কা ছিল, ‘সংসদ নির্বাচনের পর ফলাফল যদি ক্ষমতাসীন দলের মনঃপূত না হয়, তাহলে তারা পুরোনো সংসদ ডেকে নির্বাচনী ফল বাতিল করে সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে পারে।’ বিবিসিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আগের ৯০ দিনে সংসদ অধিবেশন বসবে না। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণে এই আশঙ্কা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছিল। এবার কেউ কি এর একটা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেবেন?

ওই সময় সংসদ রাখা না রাখা নিয়ে আমি টানা পাঁচ পর্বের নিবন্ধ লিখেছিলাম। সেখানে বলেছিলাম, এমন প্রায় অর্ধ ডজন অনুচ্ছেদ রয়েছে, যা একটির সঙ্গে আরেকটির সংঘাত তৈরি করে রেখেছে। এর একটা স্থায়ী সুরাহা দরকার। ভারতসহ বিশ্বের উন্নত কোনো সংসদীয় ব্যবস্থায় ১০ শতাংশ অনির্বাচিতকে পাঁচ বছর মেয়াদে মন্ত্রী রাখেই না, আর নির্বাচনের আগে তঁাদের পদত্যাগও করতে হয় না। অথচ ক্ষমতাসীন দলীয় একজন সাবেক মন্ত্রীর কাছে কারণ জানতে চাইলে দিব্যি শোনালেন, এটা তো ‘টাইম অনারড’ বিধান। বললাম, এমন একটি দেশের নাম বলুন, যেখানে এই বিধান আছে। আর ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে এমনটা করতে বলেনি। বরং পাঁচ বছর ধরে অনির্বাচিত ব্যক্তির মন্ত্রী থাকার বর্তমান বিধান, যা জেনারেল জিয়া ১৯৭৮ সালে সামরিক ফরমানে এনেছিলেন, সেটা পাল্টে বাহাত্তরে ফিরতে বলেছে। ভারতে অনির্বাচিত কেউ অনধিক ছয় মাস মন্ত্রী থাকতে পারেন। বাহাত্তরের সংবিধানেও ওই একই বিধান ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কারও তা চাওয়া নয়, এবং সে কারণেই এ নিয়ে নীরবতা চলছে। অবশ্য শুনেছি, চারজনের পদত্যাগের বিষয়টি লোক দেখানো। এটা না করা হলে মানুষজন বলত সরকারে অনির্বাচিতরা থাকতে পারলে সংসদে না থাকা বিরোধী দলের কাউকে কাউকে তো মন্ত্রিসভায় যুক্ত করা যায়।

সে কারণেই বলছি, যদি আমরা সংসদ রেখেই প্রতিবার সংসদ নির্বাচন করতে চাই, তাহলে সেটাই নির্দিষ্ট হোক। তিন স্তরবিশিষ্ট আচরণবিধিও হতে পারে। প্রাক্–তফসিল, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন–পরবতী আচরণবিধিও দরকার। উপযুক্ত রক্ষাকবচ থাকলে কিছু সুফল তো পাওয়া যায়। তাই দ্বাদশ সংসদের ভোটের তারিখ ২০২৩ সালের ঠিক এই সময়ে হবে কি না, সেটা এখনই স্থির করা যৌক্তিক। নির্বাচন সংসদ রেখে হবে নাকি ভেঙে হবে, তা নির্ধারণের এখতিয়ার ইসির নেই। কিন্তু সংবিধানে যেহেতু দুই ব্যবস্থাই আছে, তাহলে দুই ধরনের আচরণবিধি করাটা ইসির সাংবিধানিক অধিকার।

সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদের শর্তাংশের সঙ্গে ৭২(২)-এর বিরোধ রয়েছে। ৭২(২) বলেছে, ‘সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য সংসদ আহ্বান করা হবে।’ আবার ১২৩(৩)–এর শর্তাংশ একাদশ সংসদে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের চলতি দশম সংসদের মেয়াদ অবসান না হওয়া পর্যন্ত ‘কার্যভার গ্রহণ’ নিষিদ্ধ করেছে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ২০১৯ সালের গোড়ায় বাংলাদেশে আগের (দশম সংসদ) ৩০০ নির্বাচিত সাংসদ সক্রিয় এবং পরের ৩০০ নিষ্ক্রিয় সাংসদ অপেক্ষমাণ থাকবেন।

বাংলাদেশ ৩১ ডিসেম্বরে বা ১ জানুয়ারি নতুন ৩০০ সাংসদ (স্থগিত থাকলে কিছু কম) পাবে। কিন্তু তাঁরা সংসদে বসতে পারবেন না। ঐক্যফ্রন্ট জিতলে বলবে, ‘৩০ দিনের মধ্যে সংসদ না ডাকলে সংবিধান লঙ্ঘিত হবে।’ আওয়ামী লীগ ওই শর্তাংশ দেখিয়ে বলবে, অপেক্ষা করুন। ২৮ জানুয়ারির আগে আপনাদের কার্যভার নেওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ অযথা একটি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটে পড়বে।

সিইসি এ নিয়ে কোনো আলাপ–আলোচনায় না গিয়ে এখন ‘কমপ্যাক্ট টাইমের’ যুক্তি দিচ্ছেন। তাঁর কাছে প্রশ্ন করতে চাই, তিনি কেন ১৯ আগস্ট বা ১৯ সেপ্টেম্বর তফসিল ঘোষণা না করাকে শ্রেয় মনে করেছেন? এ রকম মৌলিক বিষয় পাশ কাটিয়ে তিনি প্রথম তফসিল ঘোষণার অল্প আগে নিছক পরিহাস ও কৌতুকের খোরাক জুগিয়ে আচরণবিধিতে সামান্য পরিবর্তন এনেছেন। ২০১৩ সালে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছিল। কিন্তু তাতে নির্দলীয় থেকে দলীয় সরকারের অধীনে রূপান্তরের কোনো ছাপ ছিল না বললেই চলে। এবার নির্বাচন কমিশন
আচরণবিধিতে যে পরিবর্তন এনেছে তা হচ্ছে প্রচারণায় কাপড়ের পোস্টার ও জীবন্ত প্রাণী ব্যবহার করা যাবে না।

সংসদ ভেঙে করলে মাঠ সমতল। আবার আসন্ন নির্বাচনে কিছু মন্ত্রী-সাংসদ প্রার্থী হবেন, কিছু হবেন না। বিদ্যমান আচরণবিধি শুধু ‘প্রার্থীদের’ জন্য প্রযোজ্য। প্রার্থী না হয়ে যে মন্ত্রী-সাংসদ অন্যের পক্ষে আচরণবিধির লঙ্ঘন ঘটাবেন, তাঁদের কীভাবে ও কতটা শাস্তি দেওয়া সম্ভব হবে, তা বলা নেই। শুধু নির্বাচনের দিন প্রার্থী না হওয়া মন্ত্রী বা সাংসদেরা ভোটদান ছাড়া অন্য কারণে ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি বিধি লঙ্ঘন করলে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

আপাতত কিছু বিষয় পরিপত্র জারি করে পরিষ্কার করা ভালো। প্রার্থী মন্ত্রী ও সাংসদেরা প্রটোকল পাবেন না, নিরাপত্তা পাবেন। প্রটোকল কী কী তা নির্দিষ্ট করুন। সার্কিট হাউস বা সরকারি স্থাপনায় নির্বাচনী প্রচারণা বারণ।

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক