রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন কি নিরাপদ?

আজ ১৫ নভেম্বর থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শুরুর কথা। পরিকল্পনা অনুযায়ী আজ থেকে প্রতিদিন ১৫০ জন করেÑপ্রথম দফায় মোট ২ হাজার ২৬০ জন রোহিঙ্গা আরাকানে ফিরবে। তবে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রবল অনিশ্চয়তা ছিল, আদৌ পরিকল্পনামতো প্রত্যাবর্তন হবে কি না। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে ইতিমধ্যে এই উদ্যোগের বিষয়ে সতর্ক করেছে। ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মিয়ানমারের কোনো অঙ্গীকার ছাড়া এইরূপ ‘প্রত্যাবর্তন উদ্যোগ’ ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে জাতিসংঘ। যুক্তরাষ্ট্রও জাতিসংঘের এই অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। একই সুরে বিবৃতি দিয়েছে ৪২টি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সাহায্য সংস্থা, যারা উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের নানানভাবে সহায়তা দিয়ে আসছে। তবে ভারত ও চীন চলতি প্রক্রিয়াকে সমর্থন দিয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আজকের উদ্যোগটি হলো একই লক্ষ্যে এই বছরের দ্বিতীয় আয়োজন। এর আগে গত জানুয়ারিতে অনুরূপ আরেক দফা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

প্রত্যাবর্তনে ১৯ বছর লাগবে!
প্রায় ১৫ মাস হলো রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে। স্বাধীনতার পর এই সময়টাই ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়। সর্বশেষ সোয়া বছরের সালতামামি করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার সামনে সৃষ্ট কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বুদ্ধিদীপ্ত অবস্থান নিতে পারেনি। যদি আজ থেকে পরিকল্পনামতো দিনে ১৫০ জন করে রোহিঙ্গা কোনো ধরনের বাধাবিঘ্ন ছাড়া ফেরতও যায়, তাহলেও তালিকাভুক্ত শরণার্থী-রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পূর্ণ প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রায় ১৯ বছর সময় লাগবে। উপরন্তু, এর মাঝে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বসবাস নিরাপদ না করা গেলে প্রত্যাবর্তনের এই সময়পঞ্জিও ঠিকঠাক রাখা যাবে না।

সুবিধাজনক অবস্থানে মিয়ানমার
মিয়ানমারের জন্য চলতি পরিস্থিতি চরম সুবিধাজনক এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। আজ রোহিঙ্গারা ফেরত যাওয়া শুরু করলেও দেশটির শাসকেরা লাভবান, না গেলে অধিক লাভবান। প্রত্যাবর্তন শুরু হলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মিয়ানমারের নেতৃত্ব বলার সুযোগ পাবে যে সমস্যাটি এখন সমাধান অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। এতে করে প্রায় একঘরে অবস্থা থেকে দেশটি রেহাই পাবে। আর প্রত্যাবর্তন বন্ধ থাকলে যে তীব্র বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় নামবে মিয়ানমার। তার আলামতও মিলতে শুরু করেছে। ‘চুক্তি করেও শরণার্থীদের ফেরত না দেওয়া’র জন্য ঢাকাকে দায়ী করবে তখন নেপিডো সরকার। মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ীই ১৫ নভেম্বর থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন শুরুর কথা।

জাতিসংঘ যে কারণে বিরোধিতায়
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশেলে সর্বশেষ গত পরশু জেনেভা থেকে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা বাংলাদেশের জন্য রীতিমতো হুমকিস্বরূপ। তিনি বলছেন, এ মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার পাঠানো হবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। তাঁর মতে, কক্সবাজার থেকে শরণার্থীরা বর্তমান বাস্তবতায় যেতে চাইছে না। আর শরণার্থীদের জোর করে ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইন সমর্থন করে না।

এই বক্তব্যের পরও বাংলাদেশ যদি শরণার্থীদের পাঠায়, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন কূটনীতিক ঝুঁকি তৈরি হতে বাধ্য। ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে কোনো বিপদে পড়লে তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহজেই বাংলাদেশকে দোষারোপ করার সুযোগ পাবে। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ এত দিন যে সহানুভূতি ভোগ করছে, তা এখন হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছে। জাতিসংঘের এই বক্তব্য খুবই যৌক্তিক যে আরাকানে রাষ্ট্রীয় যেসব পদক্ষেপের কারণে রোহিঙ্গারা ভীতির মুখে পালাতে বাধ্য হয়েছে, তার অবসানে দেশটির সরকার এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যার বড় প্রমাণ, এ বছরও অন্তত ১৪ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে।

ঠিক এ কারণেই জাতিসংঘের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরতে অনিচ্ছুক। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোর সর্বত্র একই মনোভাব দেখা গেছে। শরণার্থীরা মনে করে, যে পরিস্থিতির কারণে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে আসতে হয়েছে, সেই একই পরিস্থিতি এখনো বহাল রয়েছে মিয়ানমারে।

রোহিঙ্গারা উদ্বিগ্ন
যেসব শরণার্থীর নাম চলতি প্রত্যাবর্তন তালিকায় রয়েছে, তারা বলছে, সম্মতি ও আলাপ-আলোচনা ছাড়াই তাদের নাম বাছাই করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার বলছে, প্রত্যাবর্তনের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায়ই নাম লিখিয়েছে। ব্রিটেনের গার্ডিয়ানসহ আন্তর্জাতিক কিছু প্রচারমাধ্যমে ইতিমধ্যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, প্রত্যাবর্তনের কথা শুনে মানসিক চাপে কয়েকজন রোহিঙ্গা আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছে।

উল্লেখ্য, নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে বাংলাদেশে থাকা প্রায় ১০ লাখ ২৫ হাজার শরণার্থীর বাইরে আরাকানে বর্তমানে যে দেড় লাখ মতো রোহিঙ্গা রয়েছে, তারাও এখনো উদ্বাস্তু অবস্থায় বিভিন্ন ক্যাম্পে রয়েছে। এর বাইরে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন নো-ম্যানস-ল্যান্ডে। উপরিউক্ত দুই ধরনের রোহিঙ্গা অবস্থানেও মিয়ামনার সরকারের মনোভাবের কোনো মানবিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না, যা কক্সবাজারের শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন না করার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এ ছাড়া আগেও রোহিঙ্গারা যেসব দ্বিপক্ষীয় আয়োজনে আরাকানে ফিরে গেছে,Ñতাদের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। ফলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এরূপ মনোভাব এখন প্রবল যে আরাকানে আন্তর্জাতিক উপস্থিতি ছাড়া তারা আর ফিরবে না।

নাফের অপর পাড়ের সূত্র জানিয়েছে, যদি আজ প্রত্যাবর্তন শুরু হয়, তাহলে ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের হ্লা পোনে খং নামের একটি এলাকায় ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখা হবে। এই ক্যাম্পে ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে সেখান থেকে কবে তারা নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরতে পারবে বা আদৌ সেটা তারা পারবে কি না, সে বিষয়ে বাংলাদেশ বা মিয়ানমার কোনো তরফ থেকেই কোনো বক্তব্য নেই। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, আরাকানের রোহিঙ্গাদের জন্য যে ট্রানজিট ক্যাম্প তৈরি হয়েছে, তাতে ভারত ও চীন সহায়তা দিচ্ছে মিয়ানমার সরকারকে। আরাকানের বিভিন্ন স্থানে এই দুই দেশ গত এক বছরে নেপিডো সরকারের সঙ্গে অনেকগুলো বৃহৎ বিনিয়োগ চুক্তিও করেছে।

বাংলাদেশ কূটনৈতিক ঝুঁকিতে
রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের সর্বশেষ কূটনৈতিক পদক্ষেপ হলো মিয়ানমারের সঙ্গে ৩০ অক্টোবরের সমঝোতা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছাড়াই বাংলাদেশ-মিয়ানমার ওই সমঝোতার কথা জানায়। সর্বশেষ ওই ‘সমঝোতা’ ছিল বাংলাদেশের রোহিঙ্গাবিষয়ক ধারাবাহিক অবস্থানেরই অংশ। আরাকানে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম ট্র্যাজেডি হলেও বাংলাদেশ বরাবরই একে দ্বিপক্ষীয় পরিসরে সমাধানের বিষয় বিবেচনা করায় অনেক ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞই বিস্মিত।

অক্টোবরে ঢাকায় দুই দেশের ‘জয়েন্ট ওয়াকিং কমিটি’র তৃতীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত ছিল, ১৫ নভেম্বর থেকে শরণার্থীদের ফেরত যাওয়া শুরু হবে। ঢাকা ও নেপিডোর এই সিদ্ধান্তের প্রতি আন্তর্জাতিক পরিসরে তখন শীতল প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। এর কারণ অবোধগম্য নয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বহু পক্ষ ইতিমধ্যে যুক্ত। তাদের কূটনীতিক ও মানবিক সহায়তা এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শক্তির জায়গা। এরূপ পক্ষগুলোকে শরণার্থী প্রত্যাবর্তন-প্রক্রিয়ায় যুক্ত না করে শুধু মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবর্তন বিষয়ে সমঝোতায় আসার ফল হয়েছে এই যে পুরো সংকট এখন জোর করে দ্বিপক্ষীয় রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের জন্য সুবিধাজনক হয়েছে। আর বাংলাদেশের জন্য হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, এর ফলে বাংলাদেশ কূটনীতিক পরিসরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ার পরিস্থিতি তৈরি হলো।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক