খাঁচায় ঢুকছে সংসদ ভবন!

সংসদ ভবন
সংসদ ভবন

খাঁচায় পোরা হচ্ছে সংসদ ভবনকে! এখন বিশ শতকের দুনিয়াসেরা দশ স্থপতির একজন লুই আই কানের সর্বশ্রেষ্ঠ এই কাজটিকে দেখতে হবে শিকের ফাঁক দিয়ে। এমন একটি অনন্য স্থাপনার মালিক হয়ে আমরা সম্ভবত বুঝতে পারছি না যে ‘এমন সম্পদ লইয়া কী করিব!’ এই সম্পদের নিরাপত্তা দরকার, সম্ভবত সংসদে যাঁরা বসেন, তাঁদের নিরাপত্তাও দরকার (সংসদ ভবনে বসে সাংসদেরা নিরাপত্তাহীন বোধ করেন কি না, এটা জানার কৌতূহল হচ্ছে)। সুতরাং একে খাঁচায় ঢোকাও! নিরাপত্তা বলে কথা!
দক্ষিণে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও উত্তরে ক্রিসেন্ট রোডের মাঝখানে ২০০ একর জায়গায় আমাদের সংসদ ভবন। বিশ শতকের নির্বাচিত ১০০টি স্থাপত্যের একটি। অনেক সময় লেগেছে এই পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে। ১৯৬২ থেকে ১৯৮১। লুই কান মারা যান চুয়াত্তরে। কিন্তু এর আগেই ১৯৭৩ সালে ভবনের ধারণাটি চূড়ান্ত করে দিয়ে যান। সংসদ ভবন, সংসদ সদস্যদের আবাসিক ভবন, দক্ষিণ দিকের খোলা অংশ জনগণের জন্য—এটাই হচ্ছে পুরো পরিকল্পনার ধারণা। এই দক্ষিণ প্লাজা বা চত্বর দীর্ঘদিন জনগণেরই থেকেছে। এই চত্বরে হেঁটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই রয়েছে।
কিন্তু নিরাপত্তার জন্য জনগণকেই সম্ভবত আমাদের সরকারগুলো সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করে। জনগণের সংসদকেও তাই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার এই উদ্যোগ আয়োজন। এই চেষ্টা নতুন নয়। এর আগেও সংসদ ভবনকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। তখন ক্ষমতায় এরশাদ। আমাদের কাছে স্বৈরশাসক। আশির দশকে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করতে গিয়ে সেই সরকার তখন ভবনটিকে বেড়া দিয়ে আটকাতে চেয়েছিল। স্থপতিদের তরফে আপত্তি ওঠায় তখন সেই ধারণা থেকে সরকারকে সরে আসতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ‘গরু-ছাগলের’ প্রবেশ ঠেকাতে হাঁটুর উচ্চতার একটি গ্রিল দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই চত্বরে মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল।
স্বৈরাচারী শাসনের সময় যেটা শুরু হয়েছিল ‘গরু-ছাগল’ ঠেকানো দিয়ে, ‘গণতান্ত্রিক’ শাসনে তা এসে দাঁড়াল মানুষ ঠেকানোতে। সংসদ ভবনে যেটা ছিল জনগণের চত্বর, সেখানে নিষিদ্ধ হলো জনগণের প্রবেশ। নিরাপত্তাচৌকি বসল বিভিন্ন স্থানে। এরপর অন্তত ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে বা দাঁড়িয়ে ভবনটি দেখার বা খোলা চত্বরটির দিকে তাকানোর সুযোগ ছিল জনগণের। এখন সেটাও যাচ্ছে, শিকের মধ্য দিয়ে দেখতে হবে খাঁচায় পোরা এই ভবনটিকে। ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে’ সংসদ সচিবালয় সংসদ ভবন চত্বরকে লোহার শিকের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলার একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে সংসদ সচিবালয় (ডেইলি স্টার, ২৩ ফেব্রুয়ারি)।
যে নিরাপত্তার জন্য খাঁচায় গিয়ে ঢুকতে হচ্ছে সংসদ ভবনকে, সেই ‘নিরাপত্তা’র বিষয়টি আসলে কী? যখন এই ভবন তৈরি হয়েছে, তখনকার নিরাপত্তার ধারণা আর এখনকার নিরাপত্তার ধারণার মধ্যে নিশ্চয়ই পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু এই ভবনটি নিরাপত্তার দিকটি কি ডিজাইনে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি? সংসদ ভবন, শেরেবাংলা নগর ও লুই কান—এসব বিষয় নিয়ে লেগে আছেন ও কিছু গবেষণার কাজ করেছেন স্থপতি সাইফ উল হক। স্থপতি কাজী খালিদ আশরাফের সঙ্গে মিলে ২০০২ সালে একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছিলেন তিনি, ‘শেরেবাংলা নগর: লুই কান অ্যান্ড দ্য মেকিং অব আ ক্যাপিটাল কমপ্লেক্স’ শিরোনামে। তাঁর শরণাপন্ন হয়েছিলাম বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার করতে। ‘সংসদ ভবনটির নিরাপত্তা আর জনগণের জন্য রাখা খোলা চত্বর বা উদ্যানের নিরাপত্তা এক জিনিস নয়। আর কী ধরনের নিরাপত্তা হুমকি রয়েছে সংসদ ভবনের, তাও পরিষ্কার নয়। ভবনটিতে প্রবেশ করার যে পথগুলো রয়েছে, তার স্থাপত্য ডিজাইনেই এর নিরাপত্তার বিষয়টি রয়েছে। দক্ষিণ দিকে যে তিনটি প্রবেশপথ রয়েছে, সেগুলো দিয়ে ভবনে প্রবেশ করতে হলে নিরাপত্তাবেষ্টনী পার হতে হয়। উত্তর দিকে পথটিও সুরক্ষিত। সাঁতার কেটে বা হেলিকপ্টার ছাড়া সংসদ ভবনে কোনো উপায়ে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবেশের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।’
তাঁর সঙ্গে আলাপ করে যে প্রশ্নগুলো মাথায় এসেছে, তা হচ্ছে সংসদ ভবন যে নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সেটা কোন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে? গোয়েন্দা রিপোর্টে কি এ ধরনের আশঙ্কা রয়েছে? যদি তা থেকে থাকে তবে এই ভবনটি বিবেচনায় নিয়ে এর নিরাপত্তা ঘাটতির বিষয়টি নিয়ে কী কোনো স্টাডি হয়েছে কি? সংসদ সচিবালয় ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে’ লোহার বেড়া দেওয়ার যে কাজ শুরু করল, সে ব্যাপারে কি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে? আর শুধু বেড়া দিয়ে বা জনগণের প্রবেশাধিকার ঠেকিয়েই কি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব?
সংসদ ভবন শুধু এর স্থাপত্যের কারণেই নয়, দেশ পরিচালনা ও গণতন্ত্রের কেন্দ্র হিসেবেও দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভবন। এর নিরাপত্তার দিকটি কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। সংসদ ভবনের নিরাপত্তার দিকটি নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পর্যালোচনার পর যদি কোনো ফাঁকফোকর চিহ্নিত হয়, তবে তা নিশ্চয় দূর করতে হবে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে সে ধরনের কিছু ধরা পড়লে এই স্থাপনাটির শৈল্পিক ও স্থাপত্য গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে করণীয় ঠিক করতে বিশেষজ্ঞ স্থপতিদের পরামর্শ নেওয়াই হচ্ছে সঠিক পথ। সে ধরনের কিছু যে হয়নি, এই বেড়া নির্মাণপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর স্থপতি ও নগর পরিকল্পকদের প্রতিক্রিয়া দেখেই তা স্পষ্ট। ‘লোহার শিকের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি হাস্যকর এবং এটা কোনো সম্ভাব্য হামলা বা অন্তর্ঘাত থেকে সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেবে না।’ এ মন্তব্য বাংলাদেশের সাবেক প্রধান স্থপতি এ এস এম ইসমাইলের (সূত্র: ডেইলি স্টার)।
সংসদ সচিবালয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে পূর্ত মন্ত্রণালয়। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে লুই কান যে চূড়ান্ত নকশাটি অনুমোদন করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ চত্বরটি পার্কসহ জনগণের জন্য খোলা রাখা হয়েছে, এর চারপাশে বেড়ার কোনো ব্যাপার নেই। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের দিকে সীমানাজুড়ে ফোয়ারা ও ছোট খালের কথা বলা আছে। এই পরিকল্পনাকে বিকৃত করে সাড়ে আট ফুট লোহার শিকের খাঁচায় আটকে যাচ্ছে আমাদের সংসদ ভবন, বিশ্বে অন্যতম সেরা স্থাপত্য, এক অনন্য শিল্পকর্ম হিসেবেও যা বিবেচিত। ‘সংসদ ভবনটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় শুধু পূর্তকাজই দেখতে পারে। এ ধরনের স্থাপনার বিষয়গুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা উচিত। আমাদের বর্তমান সংস্কৃতিমন্ত্রী একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। এ ব্যাপারে তাঁর কাছ থেকে বিশেষ উদ্যোগ আশা করছি। আমরা চাই একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে একই সঙ্গে নিরাপত্তা ও স্থাপত্যটির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হোক।’ এই অনুরোধ স্থপতি সাইফ উল হকের।
সংসদ ভবন জনগণের, শিকের ভেতর দিয়ে কেন তাদের এই ভবন দেখতে হবে? এর দক্ষিণ চত্বরটি জনগণের জন্যই করা, সেখানে জনগণকে প্রবেশের সুযোগটি না থাকলে এর মূল চেতনাটি নষ্ট হবে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই পার্লামেন্ট ভবন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। অনন্য স্থাপত্য জার্মান আইনসভা বুন্ডেস্টাগের রেইখস্টাগ ভবন। ১৮৯৪ সালে জার্মান সাম্রাজ্যের আইনসভা হিসেবে দ্বার উন্মোচিত হওয়া এই ভবনটি নব্বই সালে দুই জার্মানি এক হওয়ার পর সংস্কার করেন বিখ্যাত স্থপতি নরম্যান ফস্টার। দুনিয়ার দর্শনার্থীদের কাছে এটি এখন অন্যতম আকর্ষণীয় এক ভবন। ১৯৯৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিন কোটি ৪০ লক্ষাধিক দর্শনার্থী এই ভবন পরিদর্শন করেছেন। এই ভবনের নিরাপত্তা বলে কি তবে কিছুই নেই?
লুই কানের সর্বশ্রেষ্ঠ এই সৃষ্টিকে বিকৃত করে বেড়া তৈরির কাজটি এখনই বন্ধ করতে হবে। সংসদ ভবনকে খাঁচায় বন্দী করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিকল্প পথ নিশ্চয়ই আমাদের স্থপতি ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা দিতে পারবেন।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]