হেমন্তের হাওয়া ও মনোনয়ন চাওয়া

বছরের এই সময়টা আমার সবচেয়ে প্রিয়। শীত আসি আসি করছে, ঢাকার বাইরে এখন কোথাও কোথাও শীত নাকি পড়েও গেছে। শরতের শিউলি হেমন্তেও আছে। বছরের এই সময়টায় আকাশ থাকে নীল, নীল আকাশে কে যেন ভাসিয়ে দেয় সাদা মেঘের ভেলা। এ বছরের এই সময়টায় আমাকে পেয়ে বসে নস্টালজিয়া; মনে হয়, এমনি করে হেমন্ত আসত আমাদের ছোটবেলায়; রংপুর পিটিআইয়ের মাঠে বিকেল হওয়ার আগেই তেরছা হয়ে পড়ত হলুদ রোদ। একটা ফিরোজা রঙের কাঁটাগুল্মে ফুটত হলুদ ফুল, আর তার ওপরে উড়ত হলুদ প্রজাপতি।

এ রকম একটা মন কেমন করা মৌসুমে হঠাৎ করে মন-ভালো করা সব খবর আসতে লাগল। ড. কামাল হোসেন চিঠি দিলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপ করতে চান। পরম বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, প্রধানমন্ত্রী সংলাপে রাজি। আন্তরিক পরিবেশে সংলাপ অনুষ্ঠিত হলো গণভবনে। তারপর ঐক্যফ্রন্ট ঘোষণা দিল, তারা নির্বাচনে যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ের সামনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের শক্তি প্রদর্শনের মহড়া। প্রচণ্ড ভিড় সেই পথে। ধানমন্ডিতে থাকি, তার ধকল আমাদের ওপর দিয়ে গেছে। ৩০০ আসনের জন্য চার হাজারের বেশি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে আওয়ামী লীগ, আসনপ্রতি প্রায় ১৪ টি। ৩০ হাজার টাকা করে বিক্রি হয়েছে একেকটা ফরম, কোটি কোটি টাকা আয় হয়েছে পার্টির। মাশরাফি বিন মুর্তজা সংগ্রহ করেছেন মনোনয়ন ফরম, আর সাকিব আল হাসানকে নাকি প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন খেলায় মন দিতে। এই নিয়ে ফেসবুক উত্তাল; মাশরাফির কি নির্বাচন করা উচিত, নাকি উচিত না। সাকিবের উচিত খেলায় মন বসানো, প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তি অনেকেরই মনে ধরেছে।

বেশ একটা উৎসবেরই কিন্তু পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আরও দল–জোট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপ করেছে, জোটে দল ভেড়ানোর কাজ চলছে। আর বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে মিছিল করে যাচ্ছেন মনোনয়নপ্রার্থীরা। সেখানেই ছন্দপতনের শুরু।

আওয়ামী লীগ অফিসের ভিড়ের সময়ই শোনা যাচ্ছিল এ রকমের মন্তব্য, মনোনয়ন ফরম কি ডিজিটালি দেওয়া যেত না? তারপর ইসির পক্ষ থেকে শোনা গেল, মনোনয়ন ফরম তোলা বা জমা দেওয়ার সময় মিছিল করা, মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা করা সংগত নয়। সেটার বুঝ শুরু হলো আওয়ামী লীগের সময়, সেটা পুলিশ কার্যকর করতে গেল বিএনপির সময়। নয়াপল্টনের মতো জায়গায় এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক তো অচল হতে দেওয়া যায় না। পুলিশের অ্যাকশন। বিএনপির কর্মীদের পাল্টা অ্যাকশন। গতকালের সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় আগুনের ছবি, পুলিশের গাড়িতে হামলার ছবি। আমরা ঘর পোড়া গরু। আমরা সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাই।

কাজেই আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের দাবি, যে উৎসবমুখর পরিবেশটা দেখা দিতে শুরু করেছে, তা যেন অটুট থাকে। পুলিশের দিক থেকেও সংযম চাই, দলগুলোর দিক থেকেও সংযত আচরণ চাই। আপনারা নির্বাচন করছেন, করুন, আমরা যেন নিরাপদে চলাচল করতে পারি, কাজকর্ম করতে পারি, আমাদের সন্তানেরা যেন স্কুল–কলেজে যেতে পারে নিরাপদে, নির্ভয়ে। লোকে বলতে শুরু করেছে, আবার শুরু হলো রাজনীতির দিন! ওই যে দেখুন ডেমোক্রেসি শুরু হয়ে গেছে! আগুন, কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জের দিকে তাদের আঙুল।

এরপরের প্রশ্ন, আচ্ছা, সারা বছর রাজনীতি করলাম না; না গেলাম পার্টি অফিসে, না গেলাম নিজ নির্বাচনী এলাকায়; যথাযথ প্রক্রিয়ায় দিনের পর দিনের সাধনায় একটা একটা করে পার্টির পদ ধারণ করে, একটা একটা স্তর অতিক্রম করে সামনের দিকে এগোলাম না; একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মনে হলো, আরে তাই তো, আমারও ৩০ হাজার টাকা আছে, আমি কেন একটা মনোনয়নপত্র কিনব না! এটা কি হয়? হয় না, তা বলতে পারব না।

আমার সামনে এই মুহূর্তে একটা বই খোলা, ইউপিএল প্রকাশিত, মফিজ চৌধুরীর লেখা—বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায়। ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে বগুড়ার জয়পুরহাটে মফিজ চৌধুরী ছয় দফার পক্ষে সভা–সমিতি করে বেড়াচ্ছেন। একদিন এক কর্মী এসে বলল, ‘শেখ সাহেবের লোক ঢাকাত্তে আসিচে তোমার কাচে।’ সেই শেখ সাহেবের লোক মফিজ চৌধুরীকে ঢাকা যেতে বললেন, শেখ সাহেব তাঁকে ডেকেছেন, নমিনেশনের ইন্টারভিউ চলছে ঢাকায়, তাতে যোগ দিতে। তিনি তিন দিন পরে ঢাকা অফিসে গেলেন। তিনি লিখেছেন, আওয়ামী লীগ অফিসে গেলাম। বেলা সম্ভবত ৯ টা–১০ টা। শেখ সাহেব চোখ তুলে আমাকে দেখে মৃদু হাসলেন, পরে তাজউদ্দীনের দিকে তাকালেন। তাজউদ্দীন পাশেই বসা, তাঁর পাশে সৈয়দ নজরুল, কামরুজ্জামান হেনা বোধ হয় লম্বা টেবিলটির এপাশে বসা ছিলেন। তাজউদ্দীন মিষ্টি হেসে বললেন, ‘ওনার ইন্টারভিউ লাগবে না।’ আমাকে বললেন, ‘আপনার নমিনেশন হয়ে গেছে।’ ...গালিব বলেছেন, ‘এক হি নেগাহ, কে বস হম খাক হো গেয়ে। তিনি শুধু একবার চোখ তুলে তাকালেন, চোখের জ্যোতিতে আমি পুড়ে খাক হয়ে ছারখার। শেখের সঙ্গে এটাই আমার পহেলি মোলাকাত।’

ডেকে এনে নমিনেশন বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন, তবে যাঁকে দিয়েছেন, তিনি মাঠে-ঘাটে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই।

এসব নিয়ে বহু কথা হয়েছে—সরকারি কর্মকর্তা অবসর নিয়েই বলেন, দিন একটা; সেনাকর্তা, পুলিশকর্তা অবসর নেওয়া মাত্র বলেন, দিন একটা; ব্যবসায়ীরা দেখেন অনেক টাকা হয়েছে, বিয়ে করি নাকি মামলা করি, দিন একটা! এখন নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, খেলোয়াড়েরা খেলতে খেলতে, গাইতে গাইতে, অভিনয় করতে করতে বলছেন, দিন একটা! আমি ছোটখাটো মানুষ, আপাতত ৩০ হাজার টাকা অতিরিক্ত নেইও যে একটা নমিনেশন পেপার কিনে তার ফটো ফেসবুকে দেব, আমি বরং মহামান্য রাষ্ট্রপতির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃত করি:

‘আমাদের গ্রামে একটা প্রবাদ আছে, গরিবের বউ নাকি সবারই ভাউজ। অহন যাঁরা শহরে থাকেন, তাঁরা তো ভাউজ চিনবেন না, ভাউজ হইল ভাবি। ভাইয়ের বউকে ভাবি বলি আমরা, গ্রামে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাবিদেরকে ভাউজ ডাকা হয়। আর গরিবের বউ হইলে মোটামুটি পাড়া বা গ্রামের সবাই আইস্যা ভাউজ ডাকে। অহন রাজনীতি হইয়া গেছে গরিবের বউয়ের মতন। এখানে যে কেউ, যেকোনো সময় ঢুইকা পড়তে পারে।...কিন্তু রাজনীতি গরিবের ভাউজ। সবাই ইঞ্জিনিয়ার কইন, আর ডাক্তার কইন, এই ভিসি সাবও ৬৫ বছর হইলে কইব, আমিও রাজনীতি করুম। যারা সরকারি চাকরি করে, জজ সাবরা যারা আছে ৬৭ বছর চাকরি করব। রিটায়ার্ড কইরা কইবো “আমিও রাজনীতি করিব’’। আর্মির জেনারেল অয়, সেনাপ্রধান অয়, অনেকে রিটায়ারমেন্টে গিয়াই কয়, “আমিও রাজনীতি করিব’’। সরকারি সচিব, প্রিন্সিপাল, সেক্রেটারি, কেবিনেট সেক্রেটারি বা জয়েন্ট সেক্রেটারি প্রত্যেকেই রিটায়ার কইরা বলে “আমি রাজনীতি করিব’’।...ডাইরেক্ট রাজনীতির মধ্যে আইসা তারা ইলেকশন করবে, মন্ত্রী হয়ে যাবে, এটা যেন কেমন-কেমন লাগে।’

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ‘পুলিশের এমন ঊর্ধ্বতন ডিআইজি, আইজিরাও রাজনীতি করে। মনে মনে কই, আমরা রাজনীতি করার সময় এই পুলিশ তোমার বাহিনী দিয়া কত পাছার মধ্যে বাড়ি দিছ। তুমি আবার আমার লগে আইছ রাজনীতি করতা। কই যামু?...যার জন্যে আমার মনে হয়, আমাদের দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে না। শিল্পপতি-ভগ্নিপতিদের আগমন এভাবে হয়ে যায়। এগুলো থামানো দরকার। সবাই চাকরি শেষ করে রাজনীতিতে ঢুকতে চায়—এটা বন্ধ হওয়া উচিত।’

এতটুকুন বলে, শেষ করি আশা দিয়ে। প্রথম আলো স্লোগান নিয়েছে—ভালোর সাথে, আলোর পথে। বাংলাদেশ ভালোর সাথে চলুক, আলোর পথে চলুক। সামনের দিনগুলো কাটুক ভালোয় ভালোয়, ভবিষ্যৎ ভরে উঠুক আলোয় আলোয়। আগামী দুটি মাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যা–ই ঘটুক না কেন, শান্তিশৃঙ্খলা যেন বজায় থাকে, মানুষের জীবন–জীবিকার নিরাপত্তা যেন বজায় থাকে।

বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয়। বাংলাদেশে ভোট একটা উৎসব। তা যেন এবার উৎসবের মতোই নির্বিঘ্ন হয়। আর যা ঘটে তা যেন বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক