ইসি কখন জাগে কখন ঘুমায়!

সিইসি কে এম নুরুল হুদা। ছবি: পিআইডি
সিইসি কে এম নুরুল হুদা। ছবি: পিআইডি

ভাবমূর্তি রক্ষার এক কঠিন পরীক্ষায় পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। শেষ পর্যন্ত ইসি কি একটি সফল নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবে? এই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র। নিরপেক্ষতার পথটা কঠিন হলেও তা না করে ইসি যত কৌশলই নিক না কেন তাতে আখেরে লাভ হবে না। এমনিতেই ইসির ভাবমূর্তি খুব বেশি ইতিবাচক নয়। ইতিপূর্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মৃত ব্যক্তিদের ভোট দেওয়ার অদ্ভুতেড়ে সংবাদও শুনেছি। কোথাও কোথাও শতভাগেরও বেশি ভোট হয়েছে। এসব ঘটনায় ইসির ওপর সাধারণের আস্থা এখন তলানিতেই আছে। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যেহেতু সরকার পরিবর্তন হয় না তাই ইসিকে খুব বেশি জবাবদিহির মুখে পড়তে হয়নি। একাদশ জাতীয় নির্বাচন ইসির জন্য বড় সুযোগ ছিল। কিন্তু দিনের প্রথম সূর্য সুদিনের আভাস দিচ্ছে না। এদিক–সেদিকে মাঝেমধ্যেই কালো মেঘের আনাগোনা। শেষ পর্যন্ত কি এবারও বিএনপিকে বাইরে রেখেই নির্বাচন হবে? কারণ ইসির সাম্প্রতিক আচরণই এই প্রশ্নের সুযোগ করে দিচ্ছে।

আচরণবিধি নিয়েই কথা বলা যাক। ইসির যখন হুঁশ ফিরল বা জেগে–থাকা ঘুমের ভান যখন ভাঙল, তখন দিনের সূর্য অনেকটা গড়িয়ে একদিকে বেশ হেলে পড়েছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ রীতিমতো উৎসব করে মনোনয়ন ফরম বিতরণ করেছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা আনন্দ–উল্লাস করে, ঢাকঢোল পিটিয়ে মনোনয়ন ফরম ক্রয় করেছেন। নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের উৎসব। এই উৎসবে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ থাকবে, উচ্ছ্বাস থাকবে। উন্মাদনাও থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগের কর্মীরা তা–ই করেছেন। কোথাও মোটরসাইকেলের শোভাযাত্রাও দেখা গেছে। বাংলাদেশ বা ভারতীয় উপমহাদেশে এ রকম দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যায়। নির্বাচনী প্রার্থীরা দলবল নিয়ে রাজনীতি করতে ভালোবাসেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিতরণের সময় ধানমন্ডি এলাকার কোথাও কোথাও যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। পথচারীরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেছেন গন্তব্যে যেতে। মোহাম্মদপুরে দুই মনোনয়নপ্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে দুজন নিরীহ পথচারী মারাও গেল। সে ঘটনাতেও নির্বাচন কমিশন ওই প্রার্থীদের প্রতি রুষ্ঠ হয়েছে বলে মনে হয়নি।

কিন্তু গোল বাধল বিএনপির বেলায়।

সারা দেশই এখন সব দলের অংশগ্রহণে জমজমাট নির্বাচনের আশায় আছে। নাগরিকেরা তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে দেশের নেতা নির্বাচন করতে চান। কোনো মৃত মানুষের ভোটে নেতা নির্বাচন করতে চান না বা বিনা ভোটের জনপ্রতিনিধিদেরও দেখতে চান না তাঁদের নেতা হিসেবে। নির্বাচন ঘিরে উৎসব, প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ যখন ফিরে আসছিল, তখন বিএনপিও মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু করল। এরা আবার আরও এককাঠি সরেস। শুধু মিছিল, শোভাযাত্রাই নয়, তাঁদের কেউ কেউ হাতি নিয়ে এলেন দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে। এতক্ষণে কুম্ভকর্ণ ইসির ঘুম ভাঙল বা ঘুমের ভান ধরে থাকা নির্বাচন কমিশনের মনে হলো কোথাও কোথাও আচরণবিধি লঙ্ঘিত হতে পারে বা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে চিঠি দিয়ে আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ জারি করল ইসি। এর পরদিনই বিএনপি অফিসের সামনে পল্টন এলাকায় সংঘর্ষের সূত্রপাত। বিএনপি ও পুলিশ; দুই পক্ষই পরস্পরকে উসকানির দায়ে অভিযুক্ত করেছে। ঘটনা যা–ই হোক, আমরা গাড়ি পোড়ানো ও ভাঙচুরের দৃশ্য দেখেছি। পুলিশের গাড়ির ওপর উঠে নৃত্যরত পিকেটারকেও দেখেছি। পুলিশ বলেছে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগকারীরা বিএনপি তথা ছাত্রদলের কর্মী। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, ভাঙচুরকারীরা ছাত্রলীগের কর্মী। এ কারণে আবার ছাত্রলীগ মির্জা ফখরুলকে বক্তব্য প্রত্যাহার ও মাফ চাওয়ার জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে।

এখানে সব পক্ষেরই দায় আছে। বিএনপির কর্মীদের ভাঙচুর করা ঠিক হয়নি। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসিকে বাধ্য করতে বিএনপিকে আরও কৌশলী ও দায়িত্বশীল হতে হবে। জ্বালাও–পোড়াও, ভাঙচুরের রাজনীতি পরিত্যাগ করতে হবে। অবশ্য বুধবারের ঘটনায় যদিও ইসি বিএনপিকে দায়মুক্তি দিয়েছে। ইসির সচিব গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিএনপি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেনি। যদি আচরণবিধির লঙ্ঘনই না হয়, তবে বিএনপির মিছিল বা জমায়েতে লাঠিচার্জ কেন? বিএনপি তাহলে আগ বাড়িয়ে পুলিশের ওপর হামলা করেছে? হামলা যদি বিএনপি করে তাহলে তাদের লাভ কী? বিএনপির ৬০-৭০ জনকে পুলিশ আটক করেছে। ভাঙচুরের ঘটনায় বিএনপির ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হয়নি। তাই বিএনপির পক্ষে সহিংসতা এড়িয়ে চলাই ভালো হবে।

এ ঘটনায় পুলিশ বিএনপির নেতা–কর্মীদের আটক করলেও প্রশ্ন রয়েছে। বেশ সময় নিয়েই পুলিশের গাড়ি পোড়ানো হলো। পুলিশের উচিত ছিল হামলাকারী ও অগ্নিসংযোগকারীদের সঙ্গে সঙ্গে আটক করা। তাহলে সে কোন দলের; ছাত্রলীগ না ছাত্রদল—এই বিতর্কের সৃষ্টি হতো না। বৃহস্পতিবার রাত নাগাদ পাওয়া সংবাদে জানা যাচ্ছে, বিএনপির ৩৮ নেতা–কর্মীকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়েছে। ২৭ জনকে কারাগারে প্রেরণ করেছে। কিন্তু এই ৩৮ ও ২৭ জনের মধ্যে পুলিশের গাড়িতে ওই অগ্নিসংযোগকারী সম্ভবত নেই। কারণ পুলিশ হামলাকারীর পরিচয় প্রকাশ করেছে। কিন্তু আটকের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। বিএনপি অফিসের সামনের ঘটনায় পুলিশ যত দ্রুত সন্দেহভাজনদের আটক করেছে, মোহাম্মদপুরের সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ কিন্তু ততটা দক্ষতা দেখাতে পারেনি। পল্টনের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ছিল এবং পেছনে বিএনপি নেতাদের ইন্ধন ছিল বলে পুলিশের পক্ষ থেকেও তথ্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মোহাম্মদপুরের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ছিল কি না বা আওয়ামী লীগের কোনো নেতার ইন্ধন ছিল কি না, সে বিষয়ে পুলিশ কিছু জানায়নি; বরং গণমাধ্যমে থেকে যতটা জেনেছি, আটক একজনকে আদালত জামিন দিয়েছেন খুবই দ্রুত। কে ভাঙাল ইসি ও পুলিশের এই ঘুম?

এই ঘটনার যদি সরলীকরণ করি এভাবে; ইসি আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দেশ দিল। এর পরদিনই পুলিশ বিএনপির মিছিলে হামলা করল। এরপর বিএনপির নেতা–কর্মীরা ভাঙচুর পরিচালনা করলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের আটক করা হলো। এখান থেকে সহজেই মনে হতে পারে কোনো একটি পক্ষ বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে চাচ্ছে বা তাদের দুর্বল করতে চাইছে। ভাঙচুর করে বিএনপিও সেই ফাঁদেই পা দিয়েছে। বিএনপির অনেকেই এখন জেলে। আরও নেতা–কর্মীকে আটক করা হলে বিএনপি নির্বিঘ্নে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনের বাইরে রাখলে কাদের লাভ, সেটা ভেবে দেখার বিষয়।

তাই সব পক্ষকেই সংযত হতে হবে। বিএনপিকে যেমন শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনায় ইসিকে সহায়তা করতে হবে, তেমনি কথায় কথায় বিএনপির নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার করা বন্ধ করতে হবে। আর ইসিকে সব দলের জন্যই সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। না হলে তাদের প্রশ্নে মুখে পড়তে হবে। ইসির হঠকারী আচরণে সংকট বরং ঘনীভূত হবে। ইসির এ ধরনের আচরণ মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়; বরং নানা ধরনের শঙ্কার সৃষ্টি করবে। ইসি এখন এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছে তাদের পক্ষে বিবৃতি দিয়েও বলা সম্ভব না যে বিএনপি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে। বাস্তবে বিএনপি আচরণবিধি ভঙ্গ করে থাকতে পারে। কিন্তু কৌশলগত কারণে ইসির পক্ষে এখন তা–ও বলা সম্ভব নয়।

এক দল যখন মিছিল, শোভাযাত্রা নিয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করল, তখন ইসির আচরণবিধি লঙ্ঘনের কথা মনে আসেনি। কিন্তু আরেক দল শুরু করতেই নড়েচড়ে বসল। তখন ইসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ আনা খুবই স্বাভাবিক হবে। কিন্তু ইসি কেন এমন করল? ইসি কি সরকারি দলের আজ্ঞাবহ, নাকি ভয় পায়? তাই লোভ, লালসা, চাপ ও ভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে ইসিকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। অন্যথায় কোনো কারণে যদি প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন থেকে সরে আসে তার দায়ভার ইসিকেই নিতে হবে।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন।