ক্ষমতার সুরক্ষা ও মগজের দখল

এক

‘ক্ষমতা’ বিষয়ে জ্ঞানজগতে অসংখ্য বয়ান-ব্যাখ্যা আছে। সেসব ছাপিয়ে এরিক উলফ, জন গ্লেডহিল, রস হ্যাসিগসহ একদল নৃবিজ্ঞানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বয়ান বিবেচনায় নিচ্ছি। তাঁদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্য থেকে ‘আজটেকদের নরবলি ও নরমাংস ভক্ষণ উৎসব’ উদাহরণটি ধরলে বর্তমান সময়ের অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোয় ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের দু-একটি কৌশল বোঝা সহজ হয়।

সাড়ে চার শ বছরের একটি প্রতিষ্ঠিত জ্ঞান, ‘আজটেকরা ছিল নরমাংসভোজী। উৎসব করে হাজার হাজার মানুষের সামনে জীবন্ত মানুষের কলিজা চিরে রক্ত পান করত। কাঁচা কলিজা চিবিয়ে খেত।’

এরিক উলফের ‘ইউরোপ অ্যান্ড দ্য পিপল উইদাউট হিস্ট্রি’ বইটি জানান দিল আজটেকদের নরমাংসভোজীরূপে উপস্থাপন ইউরোপীয়দের একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও কল্পিত ইতিহাস-বয়ান। পঞ্চাশের দশকে উলফ তাঁর ‘সন্স অব দ্য শেইকিং আর্থ’ বইটিতেও সন্দেহটি জানিয়েছিলেন। বিশ্ববাসী সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে এই ইউরোপীয় বয়ানটিকেই মেনে চলছিল।

কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী মিথটি প্রতিষ্ঠিত রইল কীভাবে?

৪০০ বছর ধরে পৃথিবীকে ইতিহাস গেলানোর ক্ষমতাটিই ছিল ইউরোপীয়দের দখলে। ইতিহাস নির্মাণ-বিনির্মাণের যাবতীয় তথ্যের ওপর একচ্ছত্র ক্ষমতাটিও ছিল তাদেরই। এই মিথটিকে প্রতিষ্ঠাদানের প্রয়োজন ছিল। নইলে আজটেক সভ্যতাকে অসভ্য, বর্বর, হিংস্র ও ভয়ংকরদের সমাজ বলে দেখিয়ে তাদের দেশ দখল, নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও নির্মূল করা সম্ভব হতো না!

উলফের মতে, ইতিহাস নির্মাণের ক্ষমতাটি করায়ত্ত থাকার অসীম সুবিধা পেল ইউরোপীয়রা। সারা পৃথিবীর মানুষকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিল যে ইউরোপীয়রাই সভ্য ও শিক্ষিত; জ্ঞান-বিজ্ঞানে সেরা ও অগ্রণী। তারাই পৃথিবীর সুদূর গহিনে অপরিচিত–অজানা সব জায়গা আবিষ্কার করেছে, উপনিবেশ গড়েছে, বিচিত্র সব মানুষকে জেনেছে, চিনেছে, বশ করেছে। এডওয়ার্ড সাঈদের ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইটি উলফের পাশাপাশি রেখে পড়লে আরও ভালোভাবে বোঝা যায়, পশ্চিমারা নিজেদের শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে শীর্ষ ক্ষমতাধারী দেখাতে গিয়ে প্রাচ্যের একটি আদুল–আদুল, মায়া–মায়া, রোম্যান্টিক-আধ্যাত্মিক চেহারা নির্মাণ করে রেখেছিল।

তারা কেন তেমনটি করেছিল এবং এখনো কেন করে?

কারণ, তথ্য ও ইতিহাসের দখল নিতে পারলে, নিজের মতো করে ইতিহাস লিখিয়ে নিতে পারলে তবেই ক্ষমতাসীনের ক্ষমতা দখল নিরঙ্কুশ থাকে। সামন্ত যুগে সম্রাট বা রাজা বা সামন্তপ্রভুরা সেটি বুঝে গিয়েছিলেন। ঔপনিবেশক রাজ-রাজড়ারা যা যেভাবে বলতে চাইতেন, ঐতিহাসিকেরাও সেভাবেই লিখতেন। লিখতে বাধ্য হতেন। সারা পৃথিবী আবার অনায়াসে সেই ইতিহাসই পড়ত, পুনর্লিখন করত; দিগ্‌বিদিক ছড়িয়েও দিত। পৃথিবীজুড়ে দখলদারিত্বের মাধ্যমে যেসব উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল ইউরোপীয়রা, সেগুলোকে পুরোপুরি কবজায় রাখতে হলে উপনিবেশিতদের মনোজগতে উপনিবেশ গড়া-মগজের দখল নেওয়ার দরকার ছিল সবকিছুর আগে। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল তাদের কথাগুলোই উপনিবেশিতদের মুখ দিয়ে বলানো।

উপনিবেশিতদের মগজ দখল করে উপনিবেশকেরা ৪০০ বছর ক্ষমতাবান ছিল। আধুনিক সময়েও শাসিতর মগজ দখল করতে পারলেই শাসক দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারে। ইউরোপীয়দের মতোই চালাকিটি বুঝে ফেলেছে আধুনিক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোও। ক্ষমতাদর্পিরা বুঝে গেছে, ইতিহাস-লেখক, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের কিনে ফেলতে পারলে অনায়াসেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা যায়। এই চিত্র এখন চীন, উত্তর কোরিয়া, ভেনেজুয়েলা, কিউবা, ফিলিপাইন, তুরস্ক, তুর্কেমেনিস্তান ছাড়িয়ে বাংলাদেশেরও।

দুই
মুখরোচক, আবেগপ্রবণ ও উত্তেজক আইডিয়া, চিন্তভাবনা বা বাগাড়ম্বর যুক্ত করে মানুষকে উত্তেজিত রাখতে পারাও ক্ষমতালোভীদের সীমাহীন ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার একটি কৌশল। আমরা এই মতামতও পাই এরিক উলফের ‘এনভিশানিং পাওয়ার: আইডিওলজিস অব ডমিন্যান্স অ্যান্ড ক্রাইসিস’ এবং জন গ্লেডহিলের ‘পাওয়ার অ্যান্ড ইটস ডিসগাইজ’ বই দুটিতে। ক্ষমতাবানের আইডিয়া ও আইডিওলজি ব্যবহারের পেছনে উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষে মানুষে বিভেদ ও বিবাদ টিকিয়ে রাখা। আইডিয়ার অপপ্রয়োগের কয়েকটি উদাহরণ মধ্যযুগের ব্লাসফেমি, ইনক্যুইজিশন, উইচ-হান্টিং কিংবা হিটলারের ‘জার্মান নীল রক্ত’, ‘আর্যশক্তি’, ‘উঁচু বর্ণ’ ইত্যাদি ধারণা। হালের ‘অ্যাক্সিস অব ইভ্যল’ কিংবা ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ বা ‘ইসলামিক টেররিজম’ অথবা ‘অ্যান্টি-সেমিটিজম’ ইত্যাদিতেও আইডিয়ার অপপ্রয়োগই বেশি। বাংলাদেশেও ‘চেতনা’ এবং ‘পক্ষশক্তি-বিপক্ষশক্তি’ আইডিয়াগুলোর আপাত সুলক্ষণগুলো এখন আর নেই, বরং যাচ্ছেতাই অপব্যবহার আছে। এভাবে জনগণ মুখোমুখি দুটি যুদ্ধমান দলে বিভাজিত হয়ে থাকলেই শাসকের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এবং একচ্ছত্রতা সুনিশ্চিত থাকে।

আমজনতাকে ‘ভয় দেখানো’, ‘ভীতিকর অবস্থা তৈরি করা’ এবং ‘ভীতসন্ত্রস্ত’ রাখা ক্ষমতা সুসংহতকরণের একটি আদিতম বুদ্ধি। এই বুদ্ধি কিছুটা সময়ের জন্য খুবই কাজের। কিন্তু একসময় এই পদ্ধতিই ক্ষমতার বিনাশ ঘটায়। উদাহরণ, আজটেক নরবলি।

ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানীরা ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের সুরে সুর মিলিয়ে বলেছে, সূর্যদেবতাকে সন্তুষ্ট রেখে কৃষি, যুদ্ধবিদ্যা, জীবনযাপনের নিয়মকানুন পোক্ত রাখতে আজটেকরা এ রকম হিংস্র ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছিল। মারভিন হ্যারিসের মতো সাংস্কৃতিক বস্তুবাদী নৃবিজ্ঞানীরা বলেছেন, মেক্সিকো-গুয়াতেমালার ভূমির অনুর্বরতা, অপ্রতুল খাদ্যশস্য কিংবা আমিষের অভাব ইত্যাদি মোকাবিলায় নরবলির প্রয়োজনীয়তা ছিল। মার্শাল সাহলিন্সের মতো পরিবেশবাদী নৃবিজ্ঞানীরা নানভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড় হতে থাকার কারণে প্রকৃতি ও জনসংখ্যার ভারসাম্য আনতে নরহত্যা হতো।

কিন্তু উলফ, গ্লেডহিল, হ্যসিগসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এগুলোকে বিচ্ছিন্ন দু-একটি কারণ মানা গেলেও নরহত্যা উৎসবটি ছিল ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য একধরনের হিংস্র প্রদর্শনী। স্বর্ণ ও মণিমাণিক্যে সমৃদ্ধ আজটেকদের সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য, রাজ্য দখলের জন্য বহিরাগতরা নিয়মিত হামলা চালাত। প্রতিরক্ষা কৌশল হিসেবে ‘দ্যাখো, আমরা কত হিংস্র হতে পারি’ শিক্ষাটি দেওয়ার জন্য এই জাঁকজমকপূর্ণ বীভৎস উৎসবটির উদ্ভব। পুরোহিত ছাড়া জনগণের নরমাংস ভক্ষণের নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ কখনো মেলেনি। হাজার হাজার দর্শকের সামনে জীবন্ত মানুষের কলজে চিরে আনার মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণসহ আক্রমণকারী বহিঃশক্তিকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখা। সাধারণ মানুষ নয়, বহিরাগত যুদ্ধবন্দী, রাজবন্দী ও দাগি অপরাধীদেরই বুক চিরে ফেলা হতো।

ধর্মের প্রতি মানুষ আজন্ম দুর্বল। সূর্যদেবতার পূজা হিসেবে ধর্মের অংশ করে নেওয়াতেই আজটেকরা গভীর ভক্তিতে, বিনা প্রশ্নে প্রথাটিকে আত্মস্থ করে নিয়েছিল। এটিও এক অর্থে ক্ষমতাদর্পীদের দ্বারা আইডিয়ার অপব্যবহারই। এই প্রথা স্থানীয়দের এবং আক্রমণ–ইচ্ছুকদের ভীতসন্ত্রস্ত তো রাখতই, নিষ্ঠুর প্রকৃতির স্পেনীয় জলদস্যু, দখলদার উপনিবেশকারীদের পর্যন্ত চরম আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছিল।

আজটেক নৃপতিরা জীবন্ত মানুষের কলিজা চিরে ফেলার আতঙ্ক ছড়িয়েই টিকে থাকতে চেয়েছিল। কিন্ত এই ভীতসন্ত্রস্তকরণ কৌশলই তাদের বিনাশের কারণ হয়ে ওঠে। স্পেনীয় দখলদারেরা আজটেকভীতি দেখিয়েই সৈন্যদের নির্বিচার আজটেক হত্যায় প্ররোচিত করে। ‘ভয় দেখানোয় যদি ধরা পড়ো, তোমাদেরও পরিণতি হবে অন্য বন্দীদের মতো। তোমাদেরও জীবন্ত কলিজা চিরে ফেলা হবে। তাই হয় মারো, নয় মরো।’ হত্যাযজ্ঞের জন্য রাজার অনুমতিও মিলে যায় অতি সহজেই। মিথটি ঐতিহাসিক সত্যের রূপ নিয়ে নেওয়ার কারণেই কয়েক শ বছর তেমন জোরদার প্রশ্নটিও ওঠেনি, কেন আজটেকদের মধ্যে নিরাময়-অযোগ্য অসুখ ছড়িয়ে এবং নির্মম গণহত্যা দিয়ে সমাজব্যবস্থাটিকে ধ্বংস করে দেওয়া হলো।

এখনো পৃথিবীর গণতন্ত্রহীন দেশগুলোয় ক্ষমতাবানেরা আজটেকদের মতোই মানুষের মাঝে ভয় জিইয়ে রেখে আরও ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার একই পদ্ধতি জারি রাখে। আবার স্পেনীয়দের আদলে ‘আমরা পরাজিত হলে পরিণতি ধ্বংস’—এই ভীতি দেখিয়ে ‘মারো নয় মরো’ ধরনের উগ্র আগ্রাসী আচরণেও বাধ্য করে অনুগতদের। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আজটেক ক্যানিব্যালিজম সিনড্রোম’ দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে। এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতা শুধু গণতন্ত্রের জন্যই হুমকি নয়, কৌশলগুলো প্রয়োগকারী ক্ষমতাধরদের জন্যও আত্মবিধ্বংসী। এই আত্মবিধ্বংসী প্রবণতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সুচিন্তাপক্ষের লোকজনের ও আমজনতার এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী, কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো।