নির্বাচনী জোটের সমীকরণ

চার অক্ষরের একটি শব্দ এখন হাটে-মাঠে-ঘাটে, লোকের মুখে মুখে—নির্বাচন। এ শব্দে কত না জাদু, কত না মধু! আবার বিকর্ষণ কম না। তা সত্ত্বেও নির্বাচন ঘিরেই বেশির ভাগ জন-আলোচনা, উত্তাপ ও উত্তেজনা। সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন ফরম বেচাকেনা নিয়ে বেশ ধুন্ধুমার হলো। ঢাকার সাতমসজিদ রোডের আশপাশে গণপরিবহন চলেনি কয়েক দিন। জনভোগান্তির চূড়ান্ত। এর রেশ কাটতে না কাটতেই পল্টনের রাস্তা বন্ধ থাকল তিন দিন। এর মধ্যে যুদ্ধও হয়ে গেল এক পশলা।

আমাদের দেশ ডিজিটাল হয়ে উঠছে খুব দ্রুত। অনলাইনে এখন অনেক কাজ সারা যায়। এমনকি নির্বাচন কমিশন থেকেও বলা হয়েছে, মনোনয়নপত্র অনলাইনে জমা দেওয়া যাবে। ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে একটা জুতসই যুক্তি হলো—আমরা তো আধুনিক প্রযুক্তিকে উপেক্ষা করতে পারি না।

দেশ ডিজিটাল হলে কি হবে, যদি রাজনৈতিক দলগুলো ডিজিটাল না হয়? অনলাইনে যে মনোনয়ন ফরম বেচা যায়, কেনা যায়, এটা কি তাদের ডিজিটাল মাথায় ঢুকল না? তা না হলে ভূরুঙ্গামারী কিংবা গলাচিপা থেকে দলবল নিয়ে ঢাকায় এসে ভিড় জমানোর কারণ কী? রাস্তা আটকে সাধারণ মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে কিছু কিছু লোক বিকৃত আনন্দ পান। এ হলো তারই প্রদর্শনী, শোডাউন, চর দখলের মহড়া।

দলগুলোর মনোনয়ন ফরম বিক্রির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি ছিল নিতান্তই দলীয় ব্যাপার। তারা দেখাতে চেয়েছে, তারা অনেক জনপ্রিয়। এ জন্য তাদের পক্ষের লোকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে, ফরম কেনা মানেই সংসদ ভবনে ঢোকার টিকিট পেয়ে যাওয়া। তবে আসল খেলাটি শুরু হবে, যখন দলগুলো প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে। বড় দলগুলোর জন্য সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। দলের আদর্শের কথা বলে অমনোনীত প্রার্থীদের কতটুকু প্রবোধ দেওয়া যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আদর্শটা যে কী, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। দেশ যে অনেক আগেই দুই ভাগ হয়ে গেছে! কথাবার্তায়, চলনে-বলনে প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিপক্ষের প্রতি বিষ উগরে দেওয়ার মচ্ছব চলছে, চলবে।

মাঠে অনেকগুলো দল ও জোট। এবার এদের সংখ্যা সম্ভবত এ দেশে সর্বকালের রেকর্ড। কিন্তু মূল খেলোয়াড় দুটি। একটি হলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিস্তৃত মহাজোট। অন্যটি হলো ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তারা সব দিক থেকে আলাদা, নাকি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, এ নিয়ে তর্ক হতে পারে।

মহাজোটের মার্কা হলো নৌকা। এই জোটের কোনো কোনো শরিক নিজস্ব মার্কা নিয়েও নির্বাচনে লড়তে পারে। জাতীয় পার্টি সে রকমই জানান দিয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মার্কা হলো ধানের শীষ। তবে এখানেও ছোট শরিকেরা নিজস্ব মার্কা নিয়ে মাঠে থাকতে পারে।

মার্কা নিয়ে যারা একজোট হয়েছে, তাদের অনেকের মধ্যেই মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। লড়াইটা শেষ পর্যন্ত এক জায়গায় এসে ঠেকেছে। মহাজোটের মহাপণ হলো, ন্যূনতম আরেক মেয়াদে সরকারে থেকে ‘উন্নয়নের’ চাকাটি সচল রাখা। ঐক্যফ্রন্টের গলায় জোর আওয়াজ—ক্ষমতাসীন জোটকে হঠাতে হবে, ‘গণতন্ত্র’ পুনরুদ্ধার করতে হবে।

ঐক্যফ্রন্টের বিরুদ্ধে মহাজোটের একটি প্রশ্ন হলো, বিএনপি-জামায়াতের মার্কা ধানের শীষে কেমন করে কামাল হোসেন-রব-মান্না-কাদের সিদ্দিকীরা যান? ওরা তো ‘স্বাধীনতাবিরোধী?’ ঐক্যফ্রন্টের লোকেরাও মহাজোটের দিকে তির ছুড়ে বলছেন, তোমাদের কোলে তো বসে আছে ‘স্বৈরাচার’ আর ‘হেফাজত’।

মার্কা নিয়ে শুচিবাই এখন নেই, আগেও ছিল না। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানেন না, এ দেশের নির্বাচনগুলো আগে কেমন হতো। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, গণতন্ত্রী দল আর কংগ্রেস মিলে নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেছিল। ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে মুসলিম লীগের নেতা খাজা নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং নেজামে ইসলাম একজোট হয়ে তৈরি করেছিল কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি (কপ)। মুসলিম লীগের মার্কা ছিল হারিকেন। তো এই মার্কা নিয়ে কপ-এর প্রার্থী মিস ফাতিমা জিন্নাহ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। জামায়াত আর নেজামে ইসলামকে খুশি করার জন্য কপ-এর ৯ দফা দাবিনামার ৮ নম্বর দফায় ‘ইসলামি মূলনীতি’র কথা বলা হয়েছিল। এই দফায় ছিল: ‘কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ অনুযায়ী সত্যিকার ইসলামি সমাজব্যবস্থা ও শরিয়তের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান। এই পরিপ্রেক্ষিতে পারিবারিক আইন সংশোধন।’ জোট করার জন্য দলগুলো কত কিছুই না করে!
আইয়ুব খান ‘মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১’ জারি করেছিলেন। এটি ছিল একটা যুগান্তকারী সংস্কারমূলক আইন, সমাজে যার প্রভাব ছিল ইতিবাচক। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ ছিল এই আইনের পক্ষে। নতুন এই আইনকে তারা আধুনিক, প্রগতিশীল ও মানবিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী ছিল এই আইনের বিরুদ্ধে। তাদের মতে, এটা ছিল ইসলামবিরোধী।

রাজনৈতিক ঐক্যের স্বার্থে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ জামায়াতের এই দাবি ‘বিষ তোলার মতো’ স্বীকার করে নিয়েছিল। জামায়াত সব সময়ই ছিল মানবতাবিরোধী। একাত্তরে এসে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘যুদ্ধাপরাধ’। এ দেশের সবগুলো দল মিলেই জামায়াতকে রাজনৈতিক বৈধতা দিয়েছে তাদের সঙ্গে নির্বাচন করে, পার্লামেন্টে গিয়ে, কিংবা যুগপৎ আন্দোলন করে।

মার্কার হাতবদলও হয়। মাওলানা ভাসানীর ন্যাপের ধানের শীষ গেছে বিএনপির হাতে। আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগের লাঙ্গল এখন এরশাদের কবজায়।

রাজনীতিবিদেরা একটি কথা প্রায়ই বলে থাকেন, রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কিছু নেই। জোটের রাজনীতিতে এটি বেশ স্পষ্ট। এবারের নির্বাচনে তো আরও স্পষ্ট। ১৯৭০–এর দশকের শুরুতে যাঁরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে মুখে ফেনা তুলতেন, আজ তাঁদের অনেকেই আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়ে বসেছেন। আবার যাঁরা একসময় জিয়াউর রহমানের জমানায় মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন, দেশান্তরি হয়েছেন, হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাঁরা অনেকেই বিএনপির সঙ্গী। এর পেছনে একটি ফর্মুলা কাজ করে। আর তা হলো, প্রধান দ্বন্দ্ব কোনটি এবং কার সঙ্গে। অন্য সবকিছুই গৌণ। মূল প্রতিপক্ষকে যত দূর সম্ভব কোণঠাসা করা এবং নিজের বলয়টি যত দূর পারা যায় বিস্তৃত করা। আওয়ামী সরকারকে হঠাতে হবে, এ জন্য অনেকেই এককাট্টা। ক্ষমতায় থাকতে হবে, এ জন্য অন্য রকম সমীকরণ।

‘সুশাসন’ শব্দটি এ দেশে চাউর হয়েছে আশির দশক থেকে। ভোটারের চাওয়া ওই একটিই। সেটি কি তাঁরা পাবেন? নাকি আবারও প্রতারিত হবেন?

নির্বাচনকামী দলগুলোর এখন প্রিয় শব্দ হলো ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’—সবার জন্য সমান সুযোগ। এই ‘সবার’ মধ্যে ভোটাররা কি আছেন? ভোটার হিসেবে আমার চাওয়া হলো, আমি কি আমার ভোটটি দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারব? আমার ভোটে কি জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে? যে অমৃত বাণী শুনে একটি মার্কায় ভোট দিয়েছি, তাঁরা কি তাঁদের কথা রাখবেন?

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]