হিরো আলম ও রাজনৈতিক ভেলকি

গত সাত বছরে বেকারের হার দ্বিগুণ হলো, দেশে স্বঘোষিত হিরোদের বাজার আরও আরও চাঙা হলো। সরকারি দলের মনোনয়ন পাওয়াকেই অনেকে ভাবছেন নিশ্চিত নির্বাচনী বিজয়। ভাবছেন, শুল্কমুক্ত কোটার গাড়ি, ব্যাংকঋণের জোয়ার, পরিবারের সদস্যদের ‘অপরাধ’ মাফের সুযোগ, ভোগ-বিলাস-খ্যাতি, সবই বুঝি হাতের মুঠায় এসে গেল। তাঁরা সম্ভবত ২০১৪ সালের বিরোধীমুক্ত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৩ জন প্রার্থীর সৌভাগ্যকে হিংসা করে ঝোপ বুঝে কোপ মারতে নেমেছেন। নইলে ভুঁইফোড় এত লোক কেন প্রার্থী হতে যাবেন, টাকা খরচ করে নির্বাচন করবেন? এমন নিশ্চয়তা তাঁদের কে দিয়েছে? তাঁরা কি বোকা, নাকি অতি চালাক?

এর মধ্যে মওকা বুঝে হিরো আলম রাজনীতিতে নামলেন। কিন্তু তিনিই কি প্রথম? কত কত স্বঘোষিত হিরো আগেভাগেই কায়েম হয়ে আছেন। এবারেও অনেকে মনোনয়নপত্র কিনে বসে আছেন, ফেসবুকে বা মিডিয়ায় প্লাস্টিক-প্লাস্টিক হাসিমাখা ছবি দিচ্ছেন। কোনো কিছু না-করার হিরোইজমের তালিকায় হিরো আলম বরং শেষের দিকের লোক। কত কত অযোগ্যতা নিয়ে যাঁরা কেউ সেলিব্রিটি, কেউ বিখ্যাত সাংবাদিক, কেউ ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদ হয়ে আছেন, তাঁদের বেলা তো সবাই চুপ। কেউ টাকা আছে বলে নেতা সেজেছেন, কেউ বিখ্যাত কারও পুত্র বা কন্যা বলে গণমাধ্যম মাতাচ্ছেন, কেউবা এমনি এমনি ভাব ধরে আছেন ক্ষমতার আশ্রয়ে। কই, তাঁদের তো কেউ প্রশ্ন করে না যে ‘আপনার কী যোগ্যতা?’। টাকা, পরিবার বা ক্ষমতা পেছনে আছে বলে তাঁরা পাস, আর হিরো আলম ফেল? হিরো আলম প্রচলিত অর্থে গুণবান ও বিত্তবান না হয়েও নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছেন। এদিক থেকে নামকরা অনেক পরিবারের পুত্র-কন্যাদের চেয়ে তিনি গুণধর।

একজন যথার্থই বলেছেন, যে রাজনীতিতে সাবেক স্বৈরাচার কিংবা ডিগবাজিবিদেরা ক্লাউন, সেই রাজনীতির মঞ্চে হিরো আলমই নায়ক। যে রাজনীতিতে বিরোধী প্রার্থীরা ধাওয়ার ওপর, সেই রাজনীতির ভয়ংকরতা ঢাকতে ও মানুষকে মজাদার আলোচনায় ব্যস্ত রাখতে হিরো আলমদের প্রয়োজন। হিরো আলম নিয়ে সামাজিক মাধ্যমের মাতোয়ারাকে আরেকভাবেও দেখা যায়। এসব রং-চড়ানো ইস্যু দিয়ে নির্বাচনী রাজনীতির মূল প্রশ্নগুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখা হচ্ছে কি?

হিরো আলম যে বর্তমান সরকারের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টির লোক, সে কথাটাও ভুলে যাওয়া যায় না। টিভির টক শোতে গ্রামের ছেলে হিরো আলমকে নিয়ে মশকরা করেন কিছু সাংবাদিক। জাতীয় পার্টি সরকারের পেয়ারের পার্টি। সেই পার্টির প্রার্থীকে যদি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা যায়, ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হলে হিরো আলমকে নির্ঘাত ধাওয়া করা হতো। এমন মশকরা, জেরা করার কায়দায় প্রশ্ন করার ‘স্টাইলটা’ নতুন নয়। এভাবেই প্রশ্নের নামে বানানো ফাঁদ, মশকরা ও ধমকের মুখে পড়তে হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাসহ বিখ্যাত কয়েকজন ব্যক্তিকে। সাংবাদিকতার এই রূপ আমাদের কে দিয়েছে?

স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও গণমাধ্যম ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা আমরা আশা করতে পারি না। তারপরও বিরোধীদের কিছুটা সুযোগ থাকলে খবর ও টক শোতে ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি তাঁদেরও কথার খই ফোটাতে দেখা যেত। মানুষ ওই সব তর্ক দেখে-শুনে নিজেদের পছন্দ ঠিক করতে পারত। দুঃখের কথা, তেমন পরিবেশ বহুদিন হলো নেই। তাহলেও বিরোধী পক্ষের শূন্যতা তো পূরণ করতে হবে। সংসদে, রাজপথে, টক শোতে তাদের আসনগুলো তাই বিকল্প লোকজন দিয়ে ভরাতে হবে। সেই বিকল্প মানুষেরা সব বলবেন, কিন্তু আসল কথাটা বলবেন না। এমন পরিস্থিতিতেই জামানত বাতিল হওয়া এলিট প্রার্থীরা বিশাল গুরুত্ব পেয়ে যান। স্বঘোষিত হিরোরা প্ল্যান বি প্ল্যান সির লারেলাপ্পা দেখান, হঠাৎ ধনকুবেরেরা মনোনয়ন-বীর হয়ে যান। দলে দলে তারকারা ‘বিফলে মূল্য ফেরত’ টাইপ মনোনয়নপত্র কেনার হিড়িক লাগিয়ে দেন। হিরো আলমের ঘটনাটা এই পরিহাস হয়ে ওঠা জাতীয় ট্র্যাজেডিরই অংশ। তিনি চলমান রাজনৈতিক মেগা সিরিয়ালের মৌসুমি এক চরিত্র মাত্র। পরিহাসটা আরও মারাত্মক হয় যখন সত্যিকার হিরো মাশরাফি বিন মুর্তজা সরকারি দলের মনোনয়নপত্র কিনে হন বিতর্কিত আর মিডিয়ার তুলে আনা হিরো আলম হয়ে যান ‘সিরিয়াস’ ও গম্ভীর লোক।

মাশরাফি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি বীর নন। তাঁর কাজ খেলা দিয়ে দর্শকদের বিনোদন দেওয়া। তাঁর নজরে সত্যিকার হিরো হলেন কৃষক-শ্রমিক-ডাক্তার-প্রকৌশলী, এঁরা। অথচ আমরা জানি, জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিতে, অনেকগুলো জয় আনায় তাঁর ভূমিকা অনন্য। কিন্তু যে-ই তিনি ক্যাপ্টেন থাকা অবস্থায় অবিভক্তভাবে সরকারি দলে চলে গেলেন, অমনি তাঁর ভক্তরা বিভক্ত হয়ে গেল। সংসদীয় আসন পেতে গিয়ে মাশরাফির জাতীয় নায়কের আসনটা টলে উঠল। কিন্তু তিনি জানেন না যে রাজটিকা ছাড়া আর কোনো পরিবার থেকে ‘হিরো’ আসার গণতন্ত্র বাংলাদেশে কখনো ছিল না, এখনো নেই। যে রাজনীতি আসল হিরোদের যত্নসহকারে ‘জিরো’ বানাতে পারঙ্গম, সেই রাজনীতি জিরো থেকেই হিরো বানাবে। আর তাতে উৎসাহী হবেন হিরো আলমের মতো বেকার যুবকেরা। প্রথম আলোর আজকের খবর, ‘২৭.৪% তরুণ নিষ্ক্রিয়; পড়ালেখা, প্রশিক্ষণ অথবা কাজে নেই।’ যত বেশি উচ্চশিক্ষিত, বেকারত্ব তত বেশি। পড়ালেখা করে যে বেকারত্বে ভোগে সে—এটাই এখন বাস্তবতা। এদের সংখ্যা কোটি কোটি। এমন দেশে হিরো আলম সাহস করে পড়ালেখার পথে না গিয়ে ‘হিরো’ সেজে এবং এখন নিরাপদ দলের প্রার্থী হয়ে বুদ্ধিমানের কাজই করেছেন।

হিরো আলম তাই মাশরাফির বিপরীত। মাশরাফির মতো সংগ্রামী হিরোদের সীতার মতো বারবার পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। মুফতে পাওয়া খ্যাতি বিনিয়োগ করা বরং সহজ। আলমকে আগে কেউ সিরিয়াসলি নিত না। মনোনয়নপত্র কিনে তিনি হয়ে উঠলেন সিরিয়াস লোক। এলিট মহলের লোকেরা যখন তাঁকে উপহাস করছে, তখন শান্ত ভঙ্গিতে উকিলি যুক্তি দিয়ে তিনি দেখালেন কয়েকটি মিডিয়ার ‘এলিট বায়াস’। হিরো আলমের এই উত্থান বাংলাদেশের নিম্নবর্গীয় তরুণদের উঠে আসার গল্পের সঙ্গে মেলে। সবার বেলায় সেটা সুন্দর হয় না। কেউ মাস্তানি করে করে ব্যবসায়ী হন, সেখান থেকে নেতা হন, তারপর হয়ে যান মন্ত্রী বা সিআইপি-ভিআইপি। কেউবা চাষবাস বা ছোট ব্যবসা কিংবা প্রবাসে মজদুরি করে ধীরে ধীরে পরিবারটিকে উঠিয়ে আনেন। তাঁদেরই সন্তানেরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে ন্যায্যতার দাবি নিয়ে হাজির হন। এঁদের সন্তানেরাই কিশোরী ফুটবল দল গঠন করে দেশে-বিদেশে চমক লাগান। ইউটিউবে এঁদেরই কারও গান দেশ-বিদেশ মাতায়। আরও তলার দিকে তাঁদের পরিবার সামাল দিচ্ছে লুটেরা অর্থনীতির যাবতীয় ধ্বংসাত্মক আঘাত, আয় কমে আসার ধাক্কা। হিরো আলমের মধ্যে এই শ্রেণির জেদ দেখা গেলেও তাঁর পথটা আলাদা। তিনি নিয়েছেন বিরোধী দলকে কোণঠাসা করার রাজনৈতিক বাস্তবতার সুযোগ। যে বাস্তবতা বেকার ও প্রতিবাদী তৈরি করে, তৈরি করে হাজারো নিরীহ ‘আসামি’, সেখানে হিরো আলমদের পথই নিরাপদ পথ। সাধারণত অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই এমন ধারার হিরোদের উত্থান ঘটে। সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার সময়ে উড়ে এসে জুড়ে বসার সুযোগ কমই থাকে।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক, প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
[email protected]

আরও পড়ুন