প্রতিযোগিতার দর্শন যেভাবে আত্মহত্যা ডেকে আনে

ব্যর্থ মানুষের ‘মৃত্যু’
কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছর সাত তরুণ-তরুণী আত্মহত্যা করেছে। ঢাকায় নিরাপদে আত্মহত্যার পরিবেশ পাওয়া সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে মহাখালী থেকে বনানী রেললাইনের বিশেষ পরিচিতি আছে। এখানকার পরিসংখ্যান চমকে ওঠার মতো। তবে এই রেললাইনের ধারে যেসব টংঘর আছে, সেগুলোর মালিকেরা অনেককেই ‘সিদ্ধান্ত’ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করেন। তাঁদের ভাষ্য, কেবল তরুণ-তরুণী নয়, প্রাণের মায়া ত্যাগ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের মাঝে মধ্যবয়সীদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে ইদানীং। এরা অনেকেই হঠাৎ ‘ব্যর্থ মানুষ’। হঠাৎ বেকার; নতুন করে কাজ পাচ্ছেন না। কেউবা মার খাচ্ছেন ব্যবসায়। ‘টার্নওভার’ কমে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতায় হেরে পরিবারের কাছে বিব্রত। অথচ এই রেললাইনের দুই পাশেই রাজধানীর দুই এলিটপাড়া। ঝলমলে ঢাকার প্রচ্ছদ।

বলা বাহুল্য, রাজধানীর বনেদি গবেষণা সংস্থার কর্মকর্তাদের চেয়ে মহাখালীর এই টংঘরের বাসিন্দারাই ভালো জানেন ‘সমাজ’-এ আসলে কী ঘটছে। তবে তারকা গবেষকেরা মনোযোগ দিলে হয়তো মহাখালী-বনানী রেললাইনের সঙ্গে অর্থ পাচারের অর্থনীতির নীরব কোনো যোগসূত্রও খুঁজে পেতেন। যদিও এরূপ কারও বাড়তি মনোযোগ ছাড়াই ঘাতক সময়টি হঠাৎই যেন বাড়তি উদোম হয়ে যাচ্ছে। দেশজুড়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর হার অনেক বাড়ছে বলেই স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলছে প্রচারমাধ্যম থেকে। পলায়নপর মানুষদের তালিকায় বেড়ে গেছে তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা। যাদের সবচেয়ে বেশি জীবনবাদী থাকার কথা।

প্রতিযোগিতার নামে ‘অযোগ্য’ প্রমাণ করা হচ্ছে
আত্মহত্যার বৈশ্বিক চিত্রে অতিবয়সীদের হার বেশি। অথচ বাংলাদেশে এসে পরিসংখ্যানটি আমূল পাল্টে যাচ্ছে। এখানে তরুণ-তরুণীদের মাঝে জীবনবিমুখতার হার বেশি। বিশেষ করে শিক্ষাজীবনের মাঝপথে বা শিক্ষাজীবন পেরোনোদের মধ্যে এরূপ প্রবণতা বাড়ছে। আত্মহত্যাকারীদের মৃত্যুপূর্ববর্তী নোটগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রতিযোগিতার ক্লান্তির কথা।

এর কারণ বোধগম্য। তরুণ-তরুণীদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না করে তাদের প্রতিযোগিতায় বাধ্য করা হচ্ছে ক্রমাগত। দেশজুড়ে ভর্তি ও চাকরি সর্বত্র প্রতিযোগিতার ধরন হয়ে উঠছে বিকৃত। একটি পদের বিপরীতে ২৫০ জনকে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে বলা পুরোদস্তুর এক অসুস্থাবস্থা। রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় ভূমিকা আড়াল করে প্রচারমাধ্যমগুলো প্রতিযোগিতাকে মহিমান্বিত এবং স্মার্ট একটা ব্যাপার হিসেবে তুলে ধরতে ব্যস্ত।

নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক সমীক্ষাগুলো খোলামেলাই বলছে, বেকারত্বের হার বাংলাদেশে সর্বশেষ সাত বছরে দ্বিগুণ হলো। অথচ এর জন্য রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে দায়ী না করে এমন এক মনস্তত্ত্ব তৈরি করা হচ্ছে, যাতে তরুণেরা নিজেদের ‘অদক্ষতা ও যোগ্যতাহীনতাকেই’ ব্যর্থতার কারণ ভাবছে। এ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে হীনম্মন্যতার বোধ। পরিণতিতে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। প্রতিযোগিতার নামে চলমান ইঁদুরদৌড়ের বাইরেও একটি সফল জীবন থাকতে পারে—এই শিক্ষা সমূলে উৎপাটিত আজ। গত সেপ্টেম্বরে আত্মহত্যা করল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের গ্র্যাজুয়েট সৈকত রঞ্জন মণ্ডল। তার সুইসাইড নোট জানাচ্ছে, দুবার বিসিএস দিয়ে সে হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল। অথচ তরতাজা একটি জীবন দিয়ে বিসিএসের চেয়ে অনেক বড় কিছু করতে পারত সৈকত। সমাজ তাকে ডানা মেলে উড়তে শেখায়নি; সৈকতের রুমে পাওয়া গেছে কয়েকটি বিসিএস গাইড মাত্র।

আসন্ন ৪০তম বিসিএস দিতে চাইছে সৈকতের মতোই চার লাখ তরুণ-তরুণী। মাত্র ১ হাজার ৯০০ পদ সেখানে। কেউ জানে না বাকি ৩ লাখ ৯৮ হাজার কী করবে। কেউ সোচ্চার কণ্ঠে এও জানাচ্ছে না, বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সাংবিধানিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। তরুণ-তরুণীরা শিখছে, রাষ্ট্রের সঙ্গে বোঝাপড়া নয়, সমবয়সী অন্যদের হারিয়েই কেবল তার ‘মুক্তি’, ‘সফলতা’! এই ‘শিক্ষা’র হাত থেকে মুক্তি পেতেই গত আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের মুশফিক মাহবুব ঘোষণা দিয়ে বিদায় জানিয়েছিল সবাইকে।

প্রতিযোগিতার দর্শন যেভাবে আত্মহত্যা ডেকে আনে
আত্মহত্যার মনোভাবের পাশাপাশি অসম ও বিকৃত প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি সমাজে ঘৃণা ও বিভেদের সংস্কৃতিও উসকে দিচ্ছে। অন্যকে পরাজিত করতে পারাই ‘ভালো’ এবং অন্যকে হারাতে পারলেই আমি ‘সেরা’—এ রকম একটা চরম ভুল শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে চারদিকে। অথচ অন্যকে পরাজিত না করেও যে–কেউ ভালো ও সেরা হতে পারে।

তরুণ-তরুণীরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো বিষয়ে বিশেষ পছন্দ ও দক্ষতার অধিকারী। রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব তাকে সেদিকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া; অন্যকে ‘হারাতে হবে’—এই বোধ তৈরি করা নয়। মানুষ যখন নিজের পছন্দের কর্মক্ষেত্রে নিজেকে বারবার পেরিয়ে যেতে চায়, সেটাই হলো সুস্থ প্রতিযোগিতা। অথচ এখানে প্রতিযোগিতার প্রতিপক্ষ নির্ধারণ করা হয় ‘অপর’কে। অন্য সবাইকে পরাজিত/আহত/হীনম্মন্য করার মধ্য দিয়ে এই প্রতিযোগিতার দর্শন শেষ হচ্ছে। এটা আহত ব্যক্তিদের মনে নিজেকে অহেতুক ব্যর্থ ভাবার অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। আর অপরকে ঘৃণা করার মনোভাবের বীজ রোপণ করছে তথাকথিত ‘সেরা’র মাঝে। এই প্রক্রিয়াতেই জন্ম হচ্ছে স্বল্পসংখ্যক ‘সফল’-এর অমানবিক শ্রেষ্ঠত্বের অহং। যে অহং সুস্থ ও ঐক্যবদ্ধ সমাজের সঙ্গে বেমানান। তারই লক্ষণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্সের শিক্ষার্থী তরুণ হোসেনের আত্মহত্যার পরদিনই বিভাগে মহা ধুমধামে নবীনবরণ হয়েছে এ বছর। শোকের ছাপ দেখা যায়নি তার সতীর্থ বা শিক্ষকদের মাঝে। অথচ অতীতে এ রকমও শোনা যেত, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ মানে একটি পরিবার।

অসুস্থ প্রতিযোগিতা বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে
বাংলাদেশ ‘রাষ্ট্র’-এ চরম স্ববিরোধী একটা দিক হলো এখানে যারা প্রকৃত ‘সফল’, তারা বরাবরই প্রতিযোগিতার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ। এখানে বিপুলসংখ্যক সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এখানে যাঁরা ব্যাংক-বিমার মালিক, তাঁরা কেউ সেটা কোনো স্বীকৃত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পাননি। এখানে টিভি চ্যানেলগুলোর বেশির ভাগেরই মালিকানার জন্য সাংবাদিকতার জগতে কোনো প্রতিযোগিতার ব্যাপার ছিল না। কেবল ‘রাষ্ট্রীয় অনুমোদন’ই যথেষ্ট ছিল। এখানে অনেক প্রভাবশালী খাতেই পদোন্নতি ঘটে মূলত প্রভাবশালীদের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে; মেধা ও যোগ্যতা তাতে প্রধান শর্ত থাকে না। অথচ এমন রাজনীতিবিদ-ব্যাংকার-মিডিয়া মালিক-আমলা, সবাই হরহামেশা প্রতিযোগিতার জন্য উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন তরুণ-তরুণীদের। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া মাত্রই তাদের কাছে ‘ব্যর্থতা’।

ক্রুদ্ধ প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতার দর্শনই সাধারণভাবে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে জরুরি হলেও প্রতিনিয়ত উপরিউক্ত পরিমণ্ডলগুলো থেকে প্রচারমাধ্যম সূত্রে আমরা পাচ্ছি, ‘প্রতিযোগিতাই সৃজনশীলতার জন্ম দেয়।’ অথচ বিশ্বব্যাপী শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ সৃজনশীল কাজগুলো অধিকাংশই প্রতিযোগিতার বাইরে দাঁড়িয়ে স্বাধীন ভাবনার ফসল। বাংলাদেশে শৈশব থেকে সবাইকে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেওয়ার প্রবণতাই এখানে শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানে সৃজনশীলতার স্থায়ী খরা তৈরি করেছে কি না, সেটা গভীর এক প্রশ্ন বটে। তবে এরূপ খরাই যে তরুণ-তরুণীদের প্রতিযোগিতার নষ্ট চক্রে আটকে রাখতে রাষ্ট্রের জন্য সুবিধা করে দিয়েছে, সেটা স্পষ্ট।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক