পিকেটির পরামর্শ ও আয়করের তথ্য

ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি। ছবি: রয়টার্স
ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি। ছবি: রয়টার্স

টমাস পিকেটি ফরাসি অর্থনীতিবিদ। তাঁর লেখা প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি (একুশ শতকে পুঁজি) বইটি ২০১৩ সালে বাজারে আসার পরই ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এতে তিনি আয়বৈষম্য নিয়ে রীতিমতো তথ্যসাগরে ডুবিয়ে দিয়েছেন পাঠকদের। এই তথ্যভান্ডারের বিরাট অংশ জুড়ে আছে আয়করবিষয়ক তথ্য-উপাত্ত। কয়েকটি ধনী দেশের এক শ বছরের বেশি সময়ের ট্যাক্স বা করসংক্রান্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে পিকেটি দেখিয়েছেন কীভাবে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে আর দুনিয়াজুড়ে আয়বৈষম্য বাড়ছে। বৈষম্য কমানোর জন্য তিনি করব্যবস্থাপনা উন্নততর করার ওপর জোর দিয়েছেন।

বইটি প্রকাশের তিন বছরের মাথায় পিকেটি ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ভারতে আসেন জয়পুর সাহিত্য উৎসবে যোগ দিতে। সেখানে তিনি ভারতের প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্যের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সে দেশের সরকারকে নিয়মিত করের তথ্য প্রকাশ করার আহ্বান জানান। তখন তিনি এ–ও বলেছিলেন যে ২০০০ সাল পর্যন্ত ভারত নিয়মিত করের তথ্য প্রকাশ করত। ওই সময় আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামনিয়াম। তিনি পিকেটির আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে বলেন, এক বছরের মধ্যেই তা করা হবে। তবে বছর না ঘুরতেই ভারত সরকার ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভারতের আয়কর তথ্য প্রকাশ করে।

আয়করের তথ্য বলতে পিকেটি অবশ্য আয়করদাতাদের নাম-ধাম ও সম্পদের বিবরণী প্রকাশের কথা বলেননি। এসব তথ্য আইনগতভাবে সুরক্ষিত। তিনি বরং চেয়েছেন আয়করের ধরন-ধারণ ও প্রবণতার বিস্তারিত প্রকাশ। এসবের মধ্যে আয়ে প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ করের তুলনা, আয়করদাতাদের পেশা, শ্রেণি, বয়স ও আয়ভিত্তিক উপাত্ত, কর আদায়ের ব্যয় পরিস্থিতি, আয়কর বিবরণী দাখিলের উপাত্ত ইত্যাদি; অর্থাৎ কর ও আয়করের সেই সব তথ্যই গুছিয়ে প্রকাশ করতে হবে যা থেকে যে কেউ যেন সমাজের আয়করদাতাদের সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা পেতে পারে আর জানতে পারে সরকার তথা কর কর্তৃপক্ষ কতটা দক্ষতার সঙ্গে কর আদায় করতে পারছে।

পিকেটির কাছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহজ সূত্র হলো এ রকম যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়ানো, এই ব্যয় নির্বাহের জন্য কর আদায় করা এবং যত বিস্তারিত সম্ভব করের তথ্য নিয়মিত প্রকাশ করা। তিনি অধিক ধনীদের কাছ থেকে অধিক হারে কর আদায় করে তা গরিব ও সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয় করার ওপর জোর দিয়েছেন। তবে সমাজের সম্পদশালীরা যথেষ্ট শক্তিশালী ও তারা সরকারকে নানাভাবে প্রভাবিত করে থাকে। তাই তাদের কাছ থেকে সঠিক কর আদায় করা কঠিন। এমতাবস্থায় আয়করের তথ্য বিস্তারিতভাবে জনগণের সামনে নিয়মিত প্রকাশ করা হলে একদিকে সরকারের কাজের স্বচ্ছতা বাড়ে, অন্যদিকে বিত্তশালীদের ওপর সামাজিক চাপ তৈরি হয় বলে টমাস পিকেটি মনে করেন।

আয়করের বিস্তারিত তথ্য থেকে যে দেশে আয়বৈষম্য সম্পর্কে জানা যায়, তা সব সময় প্রচলিত পদ্ধতিতে বিশেষ করে খানা আয়-ব্যয় জরিপে ধরা পড়ে না। পিকেটির আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করে, তা থেকে বিষয়টা অনেকটা বোঝা যায়। যেমন ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ ভারতীয় আয়কর বিবরণী দাখিল করেছে কিংবা ভারতের মোট আয়করের ৮০ শতাংশ আসে মাত্র ১১ শতাংশ শীর্ষ আয়করদাতার কাছ থেকে ইত্যাদি।

পিকেটির এসব অভিমত ও আহ্বান বাংলাদেশের জন্যও বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এ দেশে কর, বিশেষ করে আয়করবিষয়ক যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়, তা অপ্রতুল। আবার অর্থমন্ত্রী বারবারই অল্পসংখ্যক আয়করদাতার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সর্বশেষ সপ্তাহব্যাপী আয়কর মেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে দেশে এখন অন্তত চার কোটি আয়করদাতা থাকা উচিত, অথচ আছে প্রায় এক কোটি। তিনি অবশ্য প্রত্যক্ষ আয়কর নয়, আরও বিভিন্ন ধরনের কর বিবেচনায় নিয়ে এ তথ্য দিয়েছেন।

অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুসারে দেশে এখন কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীর (টিআইএন) সংখ্যা ৩৫ লাখ, তাদের মধ্যে প্রায় ২০ লাখ গত অর্থবছর আয়কর বিবরণী দাখিল করেছে। সে হিসাবে বলা যায় যে প্রত্যক্ষ করদাতার সংখ্যা অনেক কম। বর্তমানে মোট কর-রাজস্বের প্রায় ৩৫ শতাংশ আসে আয়কর ও প্রত্যক্ষ কর থেকে। পরোক্ষ কর আদায় সুবিধাজনক হলেও এটি ধনী-গরিব সবার ওপর নির্বিশেষে প্রযোজ্য, ফলে বৈষম্যমূলকও বটে।

বাংলাদেশের আয়করসহ করসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সুবিন্যস্তভাবে গুছিয়ে প্রকাশ করা এখন জরুরি হয়ে গেছে। পাশাপাশি করের তথ্য অর্থনীতির অন্যান্য সূচক ও উপাত্তের সঙ্গে মিলিয়ে দেখাও অপরিহার্য। যেমন ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে হিসাব দিয়ে বলেছিলেন যে ২০১৫ সাল শেষে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫। তিনি ন্যূনতম ১ কোটি টাকা আমানত আছে এমন ব্যাংক হিসাবধারীদের পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য দিয়েছিলেন। আবার ২০১৫ সালে দেশে ১ কোটি ৯ লাখ মানুষ আয়কর বিবরণী দাখিল করেছিলেন। যদি সব কোটিপতি আয়কর বিবরণী ঠিকমতো দাখিল করে থাকেন, তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে তাঁরা আয়করদাতাদের প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ। কিন্তু এই কোটিপতিরা কী পরিমাণ আয়কর দিয়েছেন, সে তথ্য জানাও জরুরি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে প্রায় সব ধরনের তথ্য আছে। প্রতিবছর আয়কর মেলার মাধ্যমে যেমন আয়কর প্রদানকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, তেমনি এই আয়কর মেলাতেই প্রতিবছর দেশের করসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা যেতে পারে। আর এসব তথ্য থেকে সুস্পষ্টভাবে এই আভাস মিলবে যে প্রবৃদ্ধির সুফল কারা কীভাবে পাচ্ছে আর করদাতাদের অর্থ কীভাবে ব্যয় হচ্ছে।

আসজাদুল কিবরিয়া সাংবাদিক