সংকট নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে

কয়েক সপ্তাহ ধরে শ্রীলঙ্কা এমন এক নৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা দেশটির গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে একেবারে ম্লান করে দিচ্ছে। গত ২৫ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা পার্লামেন্ট স্থগিত করে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করে তাঁর জায়গায় সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষকে বসিয়ে দেওয়ার পরই এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এরপর একের পর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটে চলেছে সেখানে।

একদিকে রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। অন্যদিকে বিক্রমাসিংহে ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, সাংবিধানিকভাবে তিনিই দেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী, তাঁকে সরাতে হলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোট করতে হবে। কিন্তু সিরিসেনা বা রাজাপক্ষে সে কথায় কান দেননি। এই নিয়ে যখন দুই শিবিরে যুদ্ধোন্মদনা দেখা দিচ্ছে, তখন দেশের সর্বোচ্চ আদালত পার্লামেন্ট সচল করে ভোটের আদেশ দিলেন এবং এমপিরা রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট দিলেন।

কিন্তু পার্লামেন্টের সেই অনাস্থা প্রস্তাবও মানতে নারাজ রাজাপক্ষে। তিনি বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে শপথ নিয়েছেন। তিনিই দেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রেসিডেন্ট সিরিসেনাও বলেছেন, পার্লামেন্টে যে অনাস্থা ভোট হয়েছে, তা ত্রুটিপূর্ণ। সেখানে কণ্ঠভোট হয়েছে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোট না হলে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না।

এই দুই শিবিরের মধ্যে রশি টানাটানি যখন তীব্র পর্যায়ে, সেই মুহূর্তে একটা সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা হয়েছে গত সোমবার। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার মধ্যস্থতায় রাজাপক্ষে ও বিক্রমাসিংহের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। দুই ঘণ্টা ধরে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হলেও কোনো সমাধান হয়নি। উভয়েই এখনো বৈধ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেদের দাবি করেছেন। রাজাপক্ষে ও বিক্রমাসিংহের অনুসারীরা এখন রাজপথে বিক্ষোভ করছেন। এ অবস্থায় উভয় পক্ষের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

শ্রীলঙ্কার সংখ্যালঘু মুসলমান ও তামিল জনগোষ্ঠী রাজাপক্ষের ক্ষমতায় ফিরে আসা নিয়ে চরম আতঙ্কে রয়েছে। ২০০৫ সালে ক্ষমতায় আসার পর রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কায় কার্যত সেনা শাসন জারি করেছিলেন। ২০০৯ সালে তামিল গেরিলাদের উচ্ছেদ করতে গিয়ে তিনি যে ভয়ানক অভিযান চালিয়েছিলেন, তাতে লক্ষাধিক তামিল নাগরিক নিহত হয়। লাখ লাখ তামিল নাগরিককে নিজেদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।

তামিলদের এক রকমের নিশ্চিহ্ন করার পর সিংহলি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী নেতা রাজাপক্ষের নতুন টার্গেট হয় মুসলিম সম্প্রদায়। শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ মুসলমান। সেখানে কয়েক দফা মসজিদ ও মুসলিমদের মালিকানাধীন দোকানপাটে সিংহলি বৌদ্ধরা হামলা চালিয়েছে। জাতীয়তাবাদের নামে চালানো এই সহিংসতাকে রাজাপক্ষের লোকেরা কাজে লাগাতে চান। তাঁরা সংখ্যাগুরু সিংহলিদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে চান যে রাজাপক্ষে ক্ষমতায় এলে সিংহলিদের প্রভাব–প্রতিপত্তি বাড়বে এবং মুসলিম ও তামিলদের উত্থান ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।

২০১৫ সালে সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহে রাজাপক্ষেকে হটিয়ে দেওয়ার পর দেশটিতে গণতন্ত্রের একটি সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল। রাজাপক্ষে সংবাদমাধ্যমগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। বিক্রমাসিংহে আসার পর সেই বাধা তাদের ওপর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে সিরিসেনা গোটা শ্রীলঙ্কায় ‘জাতীয় ঐক্য’ প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছিলেন। তামিল জনগণ তাদের হারানো সহায়–সম্পদ ফিরে পাওয়ার আশা দেখতে শুরু করেছিল।

কিন্তু রাজাপক্ষের প্রত্যাবর্তনে সেই জাতীয় ঐক্যের সম্ভাবনা দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আবার দেশটিতে বিভক্তির সুর স্পষ্ট হয়ে এ অবস্থায় একমাত্র সমাধানের পথ হলো আলোচনা। কিন্তু সেই আলোচনা প্রথম দফায় ব্যর্থ হয়েছে। আবার কখন কীভাবে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হবে এখনো পর্যন্ত তা স্পষ্ট নয়। এটি শ্রীলঙ্কাকে একটি ভয়ানক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এই অনিশ্চয়তা থেকে জাতিকে রাজনীতিকেরাই বের করে আনতে পারেন। পরস্পরকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা সেই সমাধানের পূর্বশর্ত।

অনেকে বলে থাকেন, শ্রীলঙ্কা সাংবিধানিক সংকটে পড়েছে। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, সংকটটি যতটা না সাংবিধানিক, তার চেয়ে বেশি নৈতিক ও রাজনৈতিক। এখনো পর্যন্ত এটি সবার কাছে স্পষ্ট যে রাজাপক্ষের প্রধানমন্ত্রিত্ব অন্যায্য ও অসাংবিধানিক। কিন্তু তিনি ক্ষমতা দাবি করে বসে আছেন। এ অবস্থা থেকে তাঁকে এখন একমাত্র রাজনৈতিক চাপ দিয়েই সরানো সম্ভব। আর সেদিকে গেলে সংঘাত অনিবার্য। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ঘটনাপ্রবাহ সেদিকেই গড়াচ্ছে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

কিতানা আনন্দ: মিনেসোটা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক