মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্ম এখন কোনো ইস্যু নয়

তা বছর বিশেক আগে হবে, এক তরুণ আমাকে তার একটি দুঃসাহসী প্রত্যাশার কথা বলেছিল। সেটা এই যে নির্বাচনে দুটি বিষয়কে ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। একটা হচ্ছে ধর্ম, অপরটি মুক্তিযুদ্ধ। তখনকার পরিস্থিতিতে চিন্তাটা দুঃসাহসী ছিল বৈকি। কারণ, তখন আওয়ামী লীগ বলছিল তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিএনপি ভাব করছিল যে তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পক্ষে, যে জাতীয়তাবাদ বাঙালি জাতীয়তাদের ধর্মনিরপেক্ষতাকে নাকচ করে দেয় বলে তারা ভাবত। ওই তরুণের এখন বয়স বেড়েছে নিশ্চয়ই এবং এখন হয়তো সে স্বস্তি পেয়েছে এটা দেখে যে এবারের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্ম কোনোটাই ব্যবহৃত হবে না বলে সবার ধারণা। এটা কোনো আদর্শগত বিপ্লবের কারণে ঘটেনি, ঘটেছে অবস্থার কারণে। বস্তুগত অবস্থা আদর্শকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের আস্থা যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অত্যন্ত উত্সাহী প্রবক্তা, একসময় যিনি বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং দলের রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হয়েছিলেন, তিনি যোগ দিয়েছেন আওয়ামী জোটে। আবার রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও আওয়ামী জোট থেকেই নির্বাচন করবেন ঠিক করেছেন। এর বিপরীত দিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে গভীর আস্থা রেখে যাঁরা রাজনীতি করতেন এবং বিশিষ্ট অবস্থানেই ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী বিএনপির জোটে। বোঝা যাচ্ছে প্রয়োজনে আদর্শ বদলানো যায়, বিশেষ করে যদি সম্ভাবনা থাকে ক্ষমতা লাভের।

তবে এটা আমাদের স্মরণ রাখা আবশ্যক যে রাজনীতিতে ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ ওই দুটি প্রশ্নেরই মীমাংসা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। বস্তুত মীমাংসা করেই রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের ব্যাপার। রাষ্ট্রের তাতে কিছু করার নেই। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মেলানো যাবে না, এই সিদ্ধান্তে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে পৌঁছেছি। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে পরিত্যাগ করে তবেই না বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ওই ব্যাপার নিয়ে আবার বিতর্ক তাহলে তোলা হয়েছিল কেন? কারণটা তো আমরা জানি। কারণ হচ্ছে নির্বাচনে জেতার মতলব। সে মতলব হাসিলে দুই দলই ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে অবিরাম তোয়াজ করেছে, এখনো করছে।

একইভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনাও কোনো অমীমাংসিত বিষয় নয়। মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিতেই এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাই কোনো রায়ের দরকার নেই, আবশ্যকতা নেই গণভোটের। ধরেই নিতে হবে যে অল্প কিছু রাষ্ট্রদ্রোহী ভিন্ন এ দেশের সব নাগরিকই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধকে নির্বাচনের ইস্যুতে পরিণত করা হলে রাষ্ট্রদ্রোহীদের বরং সুবিধা করে দেওয়া হয়। আরও বড় বিপদ ছিল এই যে রাজনৈতিক দলবিশেষের সাফল্য-ব্যর্থতার দায়ভার গিয়ে চেপে বসবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপরে। দলের সেই দায়ভার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিজের কাঁধে নেবে কেন? কোন অপরাধে?

দেখতে পাচ্ছি যে আসন্ন নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্ম তেমন ব্যবহৃত হচ্ছে না, কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দুদিকেই আছে এবং ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের উত্সাহীরাও যেকোনো একটিমাত্র শিবিরে জমায়েত হয়েছে তা মোটেই নয়, তাদের দুই জোটেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তবে নির্বাচনী বক্তব্য তো লাগবে, না হলে কোন কথা বলে ভোট চাওয়া যাবে? আওয়ামী জোট তাই বলছে তাদের শাসনামলের উন্নয়নের কথা, অপর পক্ষ আওয়াজ তুলেছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের। তা যে কারণেই হোক মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মকে ভোটে জেতার কাজে লাগানোতে যে সুবিধা হচ্ছে না, সেটা একটা শুভ লক্ষণ বটে।

ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসাটা নতুন ঘটনা নয়, পুরোনো ব্যাপার বটে। ব্রিটিশ আমলে এবং পাকিস্তানি জমানায় ওই ব্যবস্থা ভালো জমেছিল। তাতে ভীষণ ক্ষতি হয়েছে দেশের মানুষের। ধর্মকে উচ্চে তুলে ধরে মানুষের খাওয়া-পরা, বেঁচে থাকার সংকট সম্পর্কে অন্যমনস্ক করে দেওয়া হয়েছে। ওই ঐতিহ্য এখনো শেষ হয়নি।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবসায়ের পণ্য করার ব্যাপারটা তুলনায় নতুন, এটা আগে ছিল না। একাত্তরে যুদ্ধে বিজয়ের পরমুহূর্ত থেকেই ব্যবসাটা শুরু হয়ে গেছে। বিজয়ের বছর দশেক পরেই হবে, এক বিশিষ্ট ব্যক্তির পরিচয়লিপিতে লেখা দেখেছিলাম, একসময়ে তিনি দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। একটু অস্বস্তি লেগেছিল। দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা কেন আবার বড় ব্যবসায়ী হতে যাবেন, আর হলেনই–বা, কিন্তু সেটা অমন গৌরবের সঙ্গে প্রচারের বিষয় হবে কেন? এখন বুঝতে পারছি অস্বস্তিবোধ করাটা অন্যায় ছিল। যখনকার যা। একাত্তরে হাওয়া ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে; তখন তিনি মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের পরে হাওয়া বদলেছে, সময় এসেছে ধনী হওয়ার, তিনি ধনী হওয়ার পথ ধরেছেন, নেমেছেন ব্যবসায় এবং ‘মুক্তিযোদ্ধা’ এই পরিচয় ব্যবহার করে সুবিধা করে নিয়েছেন ব্যবসার ব্যাপারে।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সাইনবোর্ড জিনিসটা খুবই কার্যকর বৈকি। একটা গল্প পড়েছিলাম। আমেরিকার এক বড় শহরে তিনটি জুতার দোকান ছিল পাশাপাশি। বড়দিন উপলক্ষে দুই পাশের দুটি দোকানে ভীষণ তোড়জোড়। সাজাচ্ছে, ঘষামাজা করছে। নতুন ডিজাইনের জুতা এনেছে। দামের ওপর ছাড় ঘোষণা করেছে। মাঝখানের দোকানদার নির্বিকার। তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। ব্যাপারটা কী? দোকান তুলে দেবে নাকি? তার তৎপরতা প্রকাশ পেল একেবারে শেষ মুহূর্তে। দোকানের পুরোনো সাইনবোর্ডটি নামিয়ে ফেলে দুই পাশের দুই দোকানের মাঝখানে টাঙিয়ে দিল এক নতুন সাইনবোর্ড। সাদামাটা সাইনবোর্ড, তাতে শুধু লেখা, একমাত্র প্রবেশপথ। ব্যস, দেখা গেল দুই পাশের দুই দোকানের শোভায় আকৃষ্ট ক্রেতারা দলে দলে ঢুকছে ওই একমাত্র পথ ধরে এবং ওই দুই দোকানেই একসঙ্গে ঢুকেছে ভেবে মনের সুখে তারা কেনাকাটা করছে এই দোকানটিতে।

এখন অবশ্য সাইনবোর্ডের তুলনায় ব্র্যান্ডের দরকার বেশি। ব্র্যান্ডের ব্যাপারে আমাদের রাজনৈতিক জোট দুটি খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। তবে তাদের গলায় আওয়াজ আছে। উন্নয়ন এবং গণতন্ত্র উদ্ধার—দুই আওয়াজই এখন প্রবল। সরকারি দল বড়াই করছে উন্নতির। সেটাই তাদের আওয়াজ। গণতন্ত্র উদ্ধারের কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা দাবি করছেন নির্বাচন তাঁদের জন্য একটি আন্দোলন। আন্দোলন জিনিসটা অবশ্য মানুষ বেশ পছন্দ করে।

নির্বাচন এলে অনেক মানুষ ভোটপ্রার্থী হন। রাজনৈতিক কর্মীরা তো থাকেনই, ঝাঁপিয়ে পড়েন ব্যবসায়ী এবং অবসরপ্রাপ্ত অসামরিক-সামরিক আমলারাও। মনে হয় জনগণের সেবা করা ছাড়া তাঁদের জীবনে অন্য কোনো অভীষ্ট লক্ষ্য নেই। কিন্তু যাঁরা ভোট দেন, তাঁরা আশ্বস্ত হন না। তাঁদের বরং সন্দেহ হয়, শিয়াল এসেছে বর্গাদার সেজে, মুরগির বর্গা চাইছে। আশঙ্কা থাকে এই শিয়াল অচিরেই স্বরূপ ধারণ করবে; তখন ঠাহর করা যাবে কে এসেছিল কোন বেশে। তা শিয়াল হোক বা অন্য কিছু হোক, গৃহস্থের তাতে কিছু আসে–যায় না।

তবে গৃহস্থের যে জোর নেই, এটা ঠিক। আগামী নির্বাচনে তাঁরা কী করবেন? বড় দুই দলের মধ্যে এক দলকে ভোট দেবেন। কোনো বিকল্প তো নেই তাঁদের সামনে। যাঁরা বুদ্ধিজীবী, তাঁরা নিজ নিজ সুবিধার হিসাব কষে বলবেন, এদিকে এসো কিংবা এই যে এটাই পথ। তখন পরিষ্কার হবে (অন্তত হওয়া উচিত) যে তাঁরা গৃহস্থের কথা ভাবছেন না, ভাবছেন নিজেদের কথাই। অথবা মনে করছেন তাঁদের যাতে সুবিধা, গৃহস্থেরও তাতেই সুবিধা। সাধারণ মানুষ যে এসব উপদেশদাতা এবং তাঁদের রাজনৈতিক দলকে পছন্দ করেন না, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁরা কী করবেন? তাঁদের তো কোনো দল নেই।

একটা গল্প দিয়ে শেষ করা যাক। শবদেহকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল কেওড়াতলার শ্মশানঘাটে। মাঝপথে দুদলে ঝগড়া লেগেছে। এক দল বলছে, ঠিক পথেই চলেছি। অন্য দল বলছে, ওটা কেওড়াতলার পথ নয়, আমতলার পথ। ভীষণ কলহ। মনে মনে মড়া বলছে, দুদলকেই আমি চিনি। কিন্তু আমার তো কিছু বলার উপায় নেই। আমি যে মড়া।

দেশের মানুষের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে কি মিল আছে ওই অসহায়ের?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক