নিজের দুর্বলতা প্রমাণ করেছে ইসি

শারমিন মুরশিদ
শারমিন মুরশিদ

প্রতি নির্বাচনের আগে পর্যবেক্ষকদের কিছু নির্দেশনা দিয়ে থাকে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যেমন: আইন মেনে চলতে হবে, নিরপেক্ষ থাকতে হবে, বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে ইত্যাদি। এবারও সেগুলো মনে করিয়ে দিয়েছে ইসি, সেটি ঠিক আছে।

তবে এবার নির্দেশনার মধ্যে কিছু অবাক হওয়ার মতো বিষয়ও ছিল। নির্বাচন কমিশন বলছে, পর্যবেক্ষকদের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। গণমাধ্যমের সঙ্গে পর্যবেক্ষকেরা কথা বলতে পারবেন না, কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না। নির্বাচন শেষে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে এমন নির্দেশনা প্রথম পেলাম।

নির্বাচন কমিশন এমন নির্দেশনা কেন দিল? একটি স্বচ্ছ নির্বাচন দিতে নির্বাচন কমিশন কি প্রস্তুত নয়? নির্বাচন কমিশন কি চায় না পর্যবেক্ষকেরা পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়া তলিয়ে দেখুক? জনমনে নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে যে আস্থাহীনতার জায়গা তৈরি হচ্ছে, এই নির্দেশনা তা আরও সুদৃঢ় করে দিল না? অস্বচ্ছতার জায়গা তৈরি করে দিল না? নির্বাচন কমিশন কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে কি না, সে প্রশ্ন উঠবেই।

পর্যবেক্ষকদের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এমন বক্তব্য দিয়ে নিজের দুর্বলতা প্রমাণ করেছে। সবার মনে প্রশ্ন জাগছে, কী লুকাতে চাইছে নির্বাচন কমিশন।

ভোটারদের তাড়িয়ে কেন্দ্র দখল হলে পর্যবেক্ষকেরা তা নির্বাচন কমিশনকে জানান। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পুলিশকেও জানান। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয়টি জানানোর ফলে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। নির্বাচন কমিশন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে।

ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা ঘটতে দেখেও পর্যবেক্ষকেরা নির্লিপ্ত থাকতে পারেন না। এটি নৈতিকতার প্রশ্ন। যে দেশে নির্বাচনে সহিংসতায় মানুষ মারা যায়, সেখানে প্রতিক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। পর্যবেক্ষকদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে নির্বাচন কমিশনকে জানানো। কমিশন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

পর্যবেক্ষকদের নিরপেক্ষ থাকতে বলার বিষয়টি সত্য। তবে নির্বাচন কমিশন এবার যেভাবে নিরপেক্ষ থাকার কথাটি বলেছে, তা সবার মনে সংশয় জাগিয়েছে। এমন বক্তব্য পর্যবেক্ষণকে অনুৎসাহিত করছে। এবার পর্যবেক্ষণ প্রথাগতভাবে যেভাবে হয় সেভাবে হচ্ছে না। এবার পর্যবেক্ষকও থাকবেন কম। রাজনৈতিক জটিলতার মধ্যে এবারের নির্বাচন হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। অথচ, বহুদিন ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছে এমন অনেক সংস্থা এবার পর্যবেক্ষণ করতে পারবে না।

নির্বাচন কমিশন বলেছে, পর্যবেক্ষকেরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। এটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। জায়গা থেকে তথ্য পাঠাতে, যোগাযোগ করতে মোবাইল ফোন লাগেই। আমার মনে হচ্ছে, পর্যবেক্ষকদের কাজটা কঠিন করে দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন বাতিল হতে পারে বলে নির্বাচন কমিশন যে হুমকি দিয়েছে, এটি লজ্জাজনক।

এবারের নির্বাচন ভিন্নমাত্রার। শাসক দলের অধীনে, সব দলের অংশগ্রহণে, সমঝোতার অভাবের মধ্যে নির্বাচন হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো খড়্গ মাথায় নিয়ে পর্যবেক্ষকেরা কাজ করবেন। অনেক পর্যবেক্ষক সংগঠন চিন্তা করছে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যাবে কি যাবে না। পর্যবেক্ষণে গেলেও কতটুকু পর্যন্ত যাবে, তা নিয়ে চিন্তিত।

যত বেশি নজরদারি, তত বেশি স্বচ্ছতা। নির্বাচন কমিশন পর্যবেক্ষকদের নিজের হাত, পা, কান, চোখ বলে মনে করবে। পর্যবেক্ষকদের মতামতগুলো কমিশন মুক্তমনে আমলে নেবে এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তাহলে বুঝব নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী ও তৎপর। নির্বাচন কমিশন আস্থা নিয়ে সংগ্রাম করছে। আস্থার জায়গা তৈরি করতে হলে এই মুহূর্ত থেকে নির্বাচন কমিশনের ভাষা বদলানো দরকার।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী ও ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা