গুরুতর অসুস্থ চকচকে পুঁজিবাজার

জৌলুশ চিরস্থায়ী নয়। কোনো কিছুরই নয়। আজ কেনা চকচকে গাড়ি বছর ঘুরতেই মলিন হয়ে যায়, কিছুটা অভ্যস্ততায়, কিছুটা বয়সের দোষে। কলকবজায় আগের সেই বনিবনা আর থাকে না। সংস্কারের দাবি সামনে এসে দাঁড়ায়। এই দাবি একবার উঠলে তা করতেই হয়; নয়তো ধুঁকে চলাই হয় একমাত্র বাস্তবতা। কিন্তু জগৎ ধুঁকে চলে না; এটা তার রীতি নয়। ফলে সময়ে সংস্কার না হলে আমূল বদলে ফেলার দাবি ক্রমে জোরালো হতে থাকে। ঠিক এই বাস্তবতাতেই এখন দাঁড়িয়ে আছে পুঁজিতন্ত্র।

গত এক দশকে একের পর এক আঘাতে রীতিমতো পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে পুঁজিতন্ত্র। সারা বিশ্বে ছড়ি ঘোরানো এই মতবাদের ভেতরের অসুখটি এখন অনেকটাই প্রকাশ্য। এরই জেরে সাধারণের কাছে আবেদন হারাচ্ছে পুঁজিবাদী কাঠামো। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি তরুণ এখন আর পুঁজিবাদকে সমর্থন করছে না। এই আস্থাহীনতা ভয়াবহ, নিঃসন্দেহে তা পুঁজিবাদের জন্যই। অবশ্য এমন আস্থাহীনতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল।

বাজারে সবার অবাধ বিচরণ ও ব্যবসায়িক মুনাফার ভাগীদার করার যে প্রতিশ্রুতি শুরুতে প্রচার করেছিল এ মতবাদ, তা এখন ফাঁকা বুলি হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। শ্রমিকের ঘামে মালিকের উদরপূর্তির এ মতবাদ এখন এর সব প্রকরণ নিয়েই সামনে হাজির। অনেক আগেই এই ভবিতব্যের কথা বলেছিলেন কার্ল মার্ক্স। মানুষের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি যে তত্ত্ব হাজির করেছিলেন, তা জন্ম দিয়েছিল পুঁজির পাল্টা মতবাদ। গত শতকে যে মতবাদকে কেন্দ্র করে বিশ্ব ওলট-পালট হয়ে গেছে, বিশ্ব দেখেছে স্নায়ুযুদ্ধ ও তার সংশ্লিষ্ট নানা বাস্তবতা, দ্বিমেরু সে বিশ্বকাঠামোয় পুঁজিকেন্দ্র সব সংকটের কারণ হিসেবে বারবার প্রদর্শন করেছে সমাজতন্ত্রকে। সমাজতন্ত্রের জুজু দেখিয়েই সে নিজের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করেছে। কিন্তু এবার পুঁজি সত্যিই সংকটে পড়েছে। সবচেয়ে বড় সংকটটি হয়েছে সমাজতন্ত্রের মতো মোক্ষম একটি দায় মুক্তির অস্ত্র হারিয়ে।

আজকের পুঁজিবাদ সবচেয়ে বড় যে সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে, তা তার নিজেরই সৃষ্ট। রক্ষণশীল বা লোকরঞ্জনবাদী কেউই অবশ্য এই অন্তর্গত সংকট নিয়ে কথা বলতে রাজি নয়। এই দুটি ঘরানার কথা বলতে হলো, কারণ এসব প্রবণতাই এখন বিশ্বে প্রকট। বিশ্বরাজনীতির ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রান্তরাষ্ট্র—সবখানেই এখন এ প্রবণতাই রাজ করছে। যুদ্ধ ঘনিয়ে আসার মতো অস্থিরতার সময়ে সাধারণত এ ধরনের প্রবণতার প্রসার হয়। কথা হচ্ছে, এখন তো সে অর্থে সর্বাত্মক কোনো যুদ্ধ হচ্ছে না। তাহলে অস্থিরতার চিহ্নবাহী এমন প্রবণতা বিস্তারের কারণ কী? এর উত্তর দিতে গেলে পাল্টা প্রশ্ন করতে হয়, সব যুদ্ধ কি ময়দানে হয়? না, হয় না। এ যুদ্ধও হচ্ছে না। এ যুদ্ধ হচ্ছে পুঁজির ঘরে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, আজকের পুঁজিতন্ত্র সত্যিকারের এক সংকটে পড়েছে। এত দিন চলে আসা অর্থনীতির কাঠামোয় জোরে ঝাঁকুনি লেগেছে। পুরোনো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো যখন আয়েশ করে বসে আছে, তখন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয়ে এক নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্ম দিচ্ছে। এটা এমনই একচেটিয়া হয়ে উঠেছে যে বর্তমান কাঠামোয় প্রতিযোগিতা শব্দটিই হারিয়ে যাচ্ছে বাজার থেকে। এ অবস্থায় পুরো ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে একটি বিপ্লব প্রয়োজন, যার মাধ্যমে প্রতিযোগিতা ফিরে আসবে, আবার বিভিন্ন খাতের একচেটিয়া প্রতিষ্ঠানের অস্বাভাবিক উচ্চ মুনাফার রথের গতি ধীর হবে এবং আগামী দিনের পথ তৈরিতে নিযুক্ত হবে মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা।

পুঁজির ইতিহাসে বাজার ছেড়ে প্রতিযোগিতার পালানোর ঘটনা অবশ্য এই সময়েই শুধু ঘটছে না; এর আগেও এমন হয়েছে। এটিকে পুঁজিবাদের জন্মসূত্রে পাওয়া ব্যাধি বলা যায়। ফলে, বাজারে প্রতিযোগিতা ফেরানোর জন্য বিভিন্ন দেশ এর আগেও কাজ করেছে। গত শতকেই যেমন যুক্তরাষ্ট্রকে রেল ও জ্বালানি খাতে মনোপলি ভাঙতে উদ্যোগ নিতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম জার্মানিতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টিকেই দেশ গঠনের কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একইভাবে ব্রিটেনেও উদ্যোগ নেওয়া হয়। সবারই উদ্যোগের মূল কথা ছিল বাজারে প্রতিযোগিতা থাকতে হবে। লাভের গুড় যেন গুটিকয়ের পেটে না যায়। আর এটি নিশ্চিতের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান, প্রণীত হয় আইন। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠান ও আইনগুলো এখন এই পরিবর্তিত বিশ্বকাঠামোয় আর ঠিকঠাক কাজ করছে না। ফলে, পুঁজির হালের অসুখ সারাতে এই সবকিছুই এখন ঢেলে সাজানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো মুক্তবাজার। অর্থাৎ, বাজার সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে, যা এক নিরবচ্ছিন্ন প্রতিযোগিতার নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু বাস্তবে ঠিক উল্টো ঘটছে। ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির শতকরা ১০ ভাগের ১ ভাগ উৎপাদন খাতের। এই খাতের বাজারের দুই–তৃতীয়াংশেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান। একটি ভালো অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মুনাফা ভাগ হওয়াই কাঙ্ক্ষিত। ইউরোপের অবস্থাও অনুরূপ। ২০০০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইউরোপের প্রতিটি খাতের শীর্ষ চার প্রতিষ্ঠানের মার্কেট শেয়ার বেড়েছে ৩ শতাংশ পয়েন্ট করে। এটা এমনই এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে দুই মহাদেশেই প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। যদিও প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকার প্রমাণ হিসেবে বিশ্বায়নকে সামনে হাজির করা হচ্ছে; কিন্তু এ কথা এখন আর খাটছে না। বিশেষত, যেসব শিল্পে সরাসরি বেচাকেনার প্রসঙ্গটি আর আসছে না, সেসব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বলে আর কিছু থাকছে না। এক হিসাবে দেখা গেছে, বৈশ্বিক অস্বাভাবিক মুনাফার পরিমাণ ৬৬ হাজার কোটি ডলার, যার দুই-তৃতীয়াংশই যুক্তরাষ্ট্রে, যার এক-তৃতীয়াংশই আসছে আবার প্রযুক্তি খাত থেকে।

মোটাদাগে প্রযুক্তি খাতের কথা বারবার বলা হচ্ছে। কারণ, এই প্রযুক্তি খাতই পুরো বৈশ্বিক অর্থনীতিকে বদলে দিচ্ছে। এটা সত্য যে গুগল ও ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠান বিনা মূল্যে গ্রাহকসেবা দিলেও বিজ্ঞাপনে ছড়ি ঘুরিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাপে ফেলছে। চিরপরিচিত খুচরা দোকানের স্থান নিয়ে নিচ্ছে আমাজনের মতো অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটার প্ল্যাটফর্ম। কেবল টিভির স্থান দখল করছে পে-টিভি। সাধারণ টিভি চ্যানেলকে হটিয়ে দিচ্ছে ইউটিউব। এ ক্ষেত্রে নাম নেওয়া যেতে পারে তুলনামূলক নতুন কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রভাব বিস্তারকারী নেটফ্লিক্সেরও।

কিন্তু এসবের মধ্য দিয়ে যে মনোপলি তৈরি হচ্ছে, তা কাটাতে আদতে কী করছেন নীতিপ্রণেতারা। এক কথায়, কিছুই না। হ্যাঁ, এটা সত্য যে সময়ে সময়ে গুগল ও ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানা গুনতে দেখা যায়। বিচিত্র সব কারণে জরিমানা গুনতে হয় তাদের। কখনো নিজের শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম থেকে নিজেরই অনৈতিক প্রচার, কখনো অন্য প্রতিষ্ঠান আত্তীকরণের সময়ে মিথ্যাচার ও শর্তভঙ্গ, কখনো ব্যবহারকারীদের অনুমতি ছাড়াই অন্যের কাছে তাদের তথ্য বেচে মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয় তাদের। কিন্তু এই জরিমানার পরিমাণ তাদের লাভের অঙ্কের কাছে একেবারে নস্যি।

বাজারের এই একচেটিয়াকরণের সংকট হচ্ছে, এটি যত একমুখী হয়, তত মুনাফায় শ্রমিকের ভাগ কমে, যেমনটা দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, নতুন শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রে জিডিপিতে শ্রমিকের ভাগ ক্রমাগত কমেছে। বরং একচেটিয়া বাজারে অন্য আরও প্রতিষ্ঠান সদা ওত পেতে থাকছে শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতার সবটা শুষে নিতে, নতুন নতুন চাহিদা সৃষ্টির মাধ্যমে। এটা এক অদ্ভুত অবস্থা। বাজার যত বল্গাহীন হয়, পুঁজি যত বড় হয়, ততই জিডিপিতে শ্রমিকের অংশ কমে। আবার মুক্তবাজারের তত্ত্ব হাজির করা পুঁজিবাদের এই দশায় নতুন প্রতিষ্ঠানও বাজারে ঢুকতে হিমশিম খাচ্ছে, যা উৎপাদনধারাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। অর্থাৎ এক চক্রে পড়ে যাচ্ছে পুরো ব্যবস্থা।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রতিযোগিতাকে ফিরিয়ে আনার ওপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনেকে এ ক্ষেত্রে মুনাফায় শ্রমিকের অংশ বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছেন। ব্রিটেনেই যেমন লেবার পার্টি শ্রমিককে প্রতিষ্ঠানের অংশীদার করার বাধ্যবাধকতার আইন করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে দেশে দেশে রক্ষণশীলতা ও লোকরঞ্জনবাদিতা জোরদারের পাশাপাশি শক্তিশালী হচ্ছে বাম ঘরানাও। বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলা হচ্ছে। শ্রমিক ইউনিয়ন, বাজারে নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ সহজ করাসহ প্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো যে সুরক্ষা ভোগ করে, তা তুলে নেওয়াসহ নানা প্রস্তাব সামনে আসছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, পুঁজিবাদী বিশ্বকাঠামোর অন্তর্গত অসুখের নানা লক্ষণ এমনভাবে দৃশ্যমান হয়েছে যে এই মুহূর্তে সংস্কার না করা হলে তা ভেতর থেকেই ভেঙে পড়তে পারে। এই অবস্থা যত দীর্ঘ হবে, বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা তত বাড়বে। এ পরিণতি থেকে বাঁচতে হলে পুঁজিকে তার প্রতিশ্রুত প্রতিযোগিতার সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

ফজলুল কবির: সহসম্পাদক, প্রথম আলো