সুষ্ঠু নির্বাচনেই কি গণতন্ত্র নিশ্চিত হয়?

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে সম্পাদকদের বৈঠকে খুব বেশি আশার কথা শোনাতে পারেননি। তাতে যে আমরা আশাহত হয়েছি তা নয়, কারণ এটাই বাস্তবতা, স্বাভাবিক এ মনোভাব। তবে এই আশাহীনতার মধ্যে আশার আলো জ্বালানোর জন্য তিনি প্রায় সবটা বাজি ধরেছেন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর। আমার মনে হয় সুষ্ঠু নির্বাচন এককভাবে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ও সাফল্য নিশ্চিত করতে পারে না। আমাদের দেশে নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পরে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচন অন্তত অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। এই চারবারই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তনও ঘটেছিল। এ সময়ে নানা ক্ষেত্রে দেশের যে উন্নতি হয়েছে, তা-ও মানতে হবে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের ১০ বছরে বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তিসহ অবকাঠামোয় ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোয় দেশের উন্নতির কথা দেশে-বিদেশে সর্বত্র সপ্রশংস স্বীকৃতি পাচ্ছে।

কিন্তু এই একই সময়ে প্রতিটি সরকারই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করতে চেয়েছে; গণমাধ্যমের সামান্য অনুসন্ধানী খবর বা লেখালেখির বাইরে সরকারগুলো সমালোচনার তথা জবাবদিহির জায়গা বিশেষ রাখেনি। তারা স্বচ্ছতার তোয়াক্কা করেনি। এ দীর্ঘ সময়ে কখনো সংসদ আশানুরূপভাবে কার্যকর হয়নি, সংসদীয় কমিটিগুলো অর্থপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জনগণ কর্তৃক প্রদত্ত আস্থার প্রতিদান হিসেবে সরকারের ওপর ন্যায্য চাপ তৈরি করতে পারেনি। দেশের সর্বোচ্চ হিসাব নিয়ন্ত্রকের পর্যবেক্ষণ ও আপত্তিগুলো সরকারের সব দপ্তরই পাশ কাটিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এ রকম দৃষ্টান্ত আরও দেওয়া যাবে। এই বাস্তবতায় সরকারের গণতান্ত্রিক চরিত্র নষ্ট হয়, দেশের গণতন্ত্রের অবক্ষয় ঘটে। এরই সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে বলব সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে অতীতে হিটলারের উত্থানের কথা, আর সম্প্রতি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি, আতাতুর্কের আধুনিক তুরস্কে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বা গণতন্ত্রের পীঠস্থান মার্কিন মুলুকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের কথা। কেন নির্বাচনের মাধ্যমে এমন অগণতান্ত্রিক ক্ষমতাপাগল নেতারা বিজয়ী হয়ে সরকারে এসেছেন, তার পটভূমি বিবেচনায় থাকা দরকার।

এ সূত্রেই প্রাসঙ্গিক হবে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের সূচনা বক্তব্যে উঠে আসা জাতীয় বিভাজনের কথা। হ্যাঁ, এই বিভাজন সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রায় সব ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে অনেকে বিরক্তি প্রকাশ করেন, অনেকে করেন আফসোস। আমার মনে হয় অতীত বা ভবিষ্যতের দোহাই দিয়ে একে পাশ কাটানো যাবে না। এর ভিত্তি আরও গভীর ও মৌলিক। এর পেছনে সক্রিয় প্রধান দুটি পক্ষের বিরোধ দুটি ক্রীড়াদলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মতো নয়। এটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বিরোধ। তাই নির্বাচনের জয়-পরাজয়ে এর রেশ কাটে না, বরং প্রতিক্রিয়ার রেশ নানাভাবে প্রকাশ পায়। দুই প্রধান দলের এই বিভাজনের ঐতিহাসিক ও আদর্শিক ভিত্তি আছে, এ নিয়ে চক্রান্ত ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের মতো চরম অপরাধ ঘটেছে এবং এর সঙ্গে অন্যায় ও অবিচার, বঞ্চনা ও পীড়নের ইতিবৃত্ত রয়েছে। এমনকি একদিকে ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করা এবং অপর দিকে বহু বাধা পেরিয়ে আইনি বিচারের পথ খোলার দ্বৈরথ অনস্বীকার্য।

এই ইতিহাসের চুলচেরা বিচারে আমরা যাব না, কেননা এসবই সবার জানা। শুধু বলব, ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডগুলো এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার বিষয় বিবেচনায় নিলে বিএনপির ওপর দায়মোচনের দায় এসে পড়ে। নিশ্চয় বিএনপি গায়ে পড়ে আত্মপক্ষ সমর্থনে যাবে না। কিন্তু ইতিহাস মাঝে মাঝে সঠিক ভূমিকা নেওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক উত্তরণের সুযোগ তৈরি করে দেয়। মনে হয়, এবারে ড. কামাল হোসেনকে সক্রিয়ভাবে সামনে পাওয়ায় তাদের ১০ বছরের সাংগঠনিক দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠার যেমন চমৎকার সুযোগ তৈরি হয়েছে, তেমনি তারা এটি কাজে লাগিয়ে জামায়াতের সঙ্গে বন্ধনটাও কাটাতে পারত। যতই বলা হোক, নিবন্ধন না থাকায় জামায়াতের এখন আর দল হিসেবে অস্তিত্ব নেই, কিন্তু বাস্তবতা হলো, জামায়াত বিএনপির ছায়ায় থেকে তাদের সঙ্গে ভোটের হিসাব–নিকাশ বজায় রেখেই এ নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ফসল, অতএব দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা এবং এর চেতনার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ রাজনীতি এ দেশে চলতে পারে না।

যদি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধোত্তর রাজনীতির আলোকে দলের অবস্থান গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হতো, তাহলে সমাজে বিরোধের অবসানের বার্তা আসত। এখন কি বাস্তবতা এমন হচ্ছে না যে ড. কামালের ছায়ায় থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট বেঁধে আগের অবস্থানে থেকেই ক্ষমতায় ফিরতে চায়? যদি তা ঘটে, তাহলে তারেক রহমানের নেতৃত্বে পুনরুজ্জীবিত বিএনপি পুনরায় আগের অবস্থানে যে ফিরবে না, তার নিশ্চয়তা কী? ড. কামাল হোসেনের পরিণতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মতো হবে না, তাই–বা কে বলতে পারে?
আবারও বলব, কামাল হোসেনের অভিভাবক-ভূমিকার ফলে বিএনপির রাজনৈতিক নবায়নের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তাকে বিভাজনের তিক্ততা দূর করার কাজেও ব্যবহার করা সম্ভব ছিল। সে কাজে ড. কামাল নিজেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারতেন। নব্বই-উত্তর সময়েও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা সুষ্ঠু নির্বাচনের ভেতর দিয়ে দুই দলের বিভাজনের মধ্যে প্রধান দুই দল ক্রমেই নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বসম্পন্ন নেতৃত্বের দিকেই ঝুঁকছে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের কিছু অবশিষ্ট নেই। দল ও রাষ্ট্র উভয়ের মধ্যেই ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটেছে। গণতান্ত্রিক আমলে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও ধর্মীয় দলের প্রতিপত্তি বেড়েছে। সরকারে রাজনৈতিক নেতৃত্বের তুলনায় আমলাদের প্রাধান্য ও প্রতিপত্তি বেড়েছে। এ ধরনের রাজনীতি পরিচালনায় দলীয় সংগঠন ও কর্মীর ভূমিকার চেয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতাই বেশি কাজে দেয়। আর প্রয়োজন হয় বিত্তবানের সহায়তা, যাঁরা দলের মাঠপর্যায়ের ক্যাডার এবং রাষ্ট্রেরও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা নিশ্চিত রাখার দায় পালন করেন। তাই দেখা যায়, বড় দুই দল নির্বাচন মাথায় রেখে তাঁদেরই, অর্থাৎ অবসরপ্রাপ্ত সিভিল-মিলিটারি-পুলিশ আমলা এবং বিত্তবান ব্যক্তিদের দলে টানে ও মনোনয়নে অগ্রাধিকার দেয়। এভাবে ১৯৯১ থেকে নির্বাচিত সরকারের ২৫ বছরে সংসদে ও দলে জনগণের অংশীদারত্ব কমেছে, কট্টর রক্ষণশীল মতাদর্শের সঙ্গে রাজনীতির সখ্য গভীর হয়েছে, সমাজে মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীলতার বাতাবরণ ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ অবস্থার জন্য শুধু সরকারকে বা ডিজিটাল আইনকে দায়ী করলে বাস্তবতা অনুধাবনে ভুল হবে। সমাজে যেসব মতাদর্শ শক্তিশালী, তা ভোটের রাজনীতিতে প্রতিফলিত হবেই।
প্রায় সব মুসলিম রাষ্ট্রেই দেখা গেছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই রক্ষণশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ক্ষমতায় এসে যায়। তার একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু পঁচাত্তরের পরে বিএনপির হাত ধরেই মূল রাজনীতিতে ধর্মীয় জাতীয়তার পাকিস্তানি ধারা শক্তভাবে পুনর্বাসিত হয়েছে। তার সঙ্গে সমকালীন বিশ্বে সৌদি আরবসহ তেলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশের সহায়তা যুক্ত হওয়ায় এর পালে লেগেছিল হাওয়া। আর যেহেতু কোনো মুসলিম সমাজেই রেনেসাঁ-পরবর্তী জ্ঞানবিজ্ঞানের ও দর্শনের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা, সংস্কারের উদ্যোগ তেমন কার্যকর হয়নি, তাই সমাজের বৃহত্তর অংশে ধর্মীয় চিন্তার গোঁড়ামি কাটেনি। অতি সম্প্রতি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় সংস্কারের কথা শোনা যাচ্ছে, গণতান্ত্রিক আবহ অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে বিপরীত যাত্রা চলছে। এখানে জ্ঞানচর্চার পীঠস্থানগুলো স্থবির হয়ে পড়েছে। তদুপরি বিভক্ত রাজনীতির প্রভাবে স্থূল ক্ষমতার দৌড়ে লিপ্ত হয়ে সমাজের শীর্ষ স্তরও অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে।
সমাজসংস্কার, সাংস্কৃতিক উজ্জীবন ও রাজনীতির গণতান্ত্রিকীকরণ ব্যতীত সুষ্ঠু নির্বাচন এককভাবে সমাজকে প্রকৃত গণতন্ত্রের পথে নিতে পারে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেবল সরকারের সমালোচনার অধিকারে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, প্রচলিত সনাতন পশ্চাৎপদ সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকারকেও পথ করে দিতে হবে। একটি সমাজে নানা বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার অবাধ মুক্ত প্রবাহ না থাকলে সে সমাজ চিন্তার জড়তায় ভোগে, স্থবিরতা ও অবক্ষয়ের শিকার হয়, হারায় প্রাণশক্তি। সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিকে বিজয়ের গ্যারান্টি দেয় না, প্রায়ই অন্ধ পশ্চাৎপদ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকেই মদদ জোগায়। আজ থেকে প্রায় এক শ বছর আগে এ দেশে মুসলিম মনীষীদের উচ্চারিত বাণীটি আজ খুব প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। মনে হয় সেটি স্মরণ করা জরুরি। তাঁরা বলেছিলেন—জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।
আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক