খতিয়ে দেখতে হবে প্রতিটি অভিযোগ

এম সাখাওয়াত হোসেন
এম সাখাওয়াত হোসেন

বিরোধী দলে যাঁরাই থাকুন, নির্বাচন এলে তাঁরা নির্বাচন কমিশনের কাছে বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আসেন। সেই অভিযোগগুলো বাস্তবে কতটা যথাযথ, তা প্রথমে দেখতে হবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জনপ্রশাসন ও পুলিশের ৯২ জন কর্মকর্তার প্রত্যাহার চেয়ে গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে। অভিযোগ হচ্ছে, এসব কর্মকর্তার অনেকে অতীতে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁরা দলীয় মনোভাবাপন্ন। তাঁরা দায়িত্বে থাকলে নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারেন।
কিন্তু মাঠপর্যায়ের এতগুলো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, এর মধ্যে আবার সচিবও আছেন, তাঁদের ঢালাওভাবে শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে বদলি করা যায় না। এর জন্য তদন্ত করতে হবে। ঢালাওভাবে বদলি করলে কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হবে। সেই আতঙ্ক কিন্তু নির্বাচনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
তবে যে অভিযোগ এসেছে, সে সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনকে খতিয়ে দেখতে হবে। এরপর এ রকম কোনো কর্মকর্তাকে যদি পাওয়া যায় যিনি একেবারেই প্রকাশ্যে একটি দলের হয়ে কাজ করছেন, তাহলে সেখানে একটা ব্যবস্থা নিতে পারে কমিশন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নজরদারির মধ্যে রাখতে পারে। যদি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ব্যত্যয় দেখা যায় বা ঘটে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা উপযাচক হয়ে অহরহ মামলা দিচ্ছেন, নির্বাচন কমিশনের উচিত এ ধরনের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
কেবল ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করার কারণে ব্যবস্থা নেওয়াটা যৌক্তিক হবে না। ছাত্রজীবনে কেউ রাজনীতি করতেই পারেন। কারণ, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাটাই এমন, যেখানে ছাত্ররাজনীতির সংস্পর্শে চলে আসেন। সেটি ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক। তা ছাড়া এ ধরনের অভিযোগ করা একধরনের রীতিই হয়ে গেছে। বিএনপির সময়কালেও এ ধরনের অভিযোগ তখন আমরা দেখেছি। তখন বলা হয়েছিল, নির্বাচন কমিশনে যেসব কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। তখন এ অভিযোগের পর তাঁদের নানা ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সেভাবে বাদ দিতে হয়েছে। কাউকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়াটা খুব বেদনাদায়ক ছিল।
নির্বাচন কমিশনে কোনো অভিযোগ এলে বিশেষ করে প্রধান বিরোধী অংশ থেকে এলে তাৎক্ষণিকভাবে তা দেখতে হবে। কোন অভিযোগগুলো প্রণিধানযোগ্য, কোনটি আমলে নেওয়ার যোগ্য নয়, তা খতিয়ে দেখে নির্ণয় করতে হবে। যদি কোনো অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সেই ব্যবস্থাগুলো হতে পারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বদলি করা বা নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা। নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, যাঁরা অভিযোগ এনেছেন তাঁদের তা অবহিত করতে হবে।
আর যাঁরা অভিযোগ করছেন, তাঁদের সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে, কোন কর্মকর্তার কোন কর্মকাণ্ড সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক নয়। একসময় ছাত্রলীগ করেছেন বা সরকারের দ্বারা প্রভাবিত কেবল ইত্যাদি বললেই হবে না। আমাদের দেশের সরকার পদ্ধতিই হলো সবকিছু এক ব্যক্তির অধীন। প্রধানমন্ত্রী সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এমন একটি সরকার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলে কে না প্রভাবিত হবেন। যিনি প্রভাবিত নন তিনিও প্রভাবিত হওয়ার ভান করবেন। এ ধরনের প্রশাসনের কাছে একটি দলনিরপেক্ষ আচরণ আশা করাও যায় না।
ঐক্যফ্রন্টের দাবি অনুযায়ী ৯২ জনকে বদলি করা হলে তাঁদের স্থলে কাদের আনা হবে? নির্বাচন কমিশন কি সবাইকে চেনে? নির্বাচন কমিশন তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলবে যে তাদের পুলিশ কর্মকর্তা বদলি করে সেখানে নতুন পুলিশ কর্মকর্তা দেওয়া হোক। নতুন যে পুলিশ কর্মকর্তা আসবেন, তিনিও যে আগের পুলিশ কর্মকর্তার চেয়ে বেশি দলীয় প্রভাবিত নন, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
আমরা যখন নির্বাচন কমিশনে ছিলাম, ২০১১ সালে শেষ যেসব প্রস্তাব দিয়ে এসেছিলাম, সেগুলো ছিল নির্বাচনী কার্যক্রমের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ যেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নির্বাচনে ভূমিকা ও প্রভাব রাখতে পারে তাদের নির্বাচন কমিশনের আওতায় আনা। সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। এই রেওয়াজ ভারতসহ অন্যান্য দেশে আছে।
আমাদের এবারের নির্বাচন খুব কঠিন একটা নির্বাচন হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের সামনে কঠিন কাজ। বদলি করলেই যে সব সমস্যার সমাধান হবে, তা নয়। তবে নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে প্রতিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখা। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে হলে নির্বাচন কমিশনের চেয়ে সরকারের ভূমিকা বেশি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার