আমি উদ্যোক্তা হতে চাই, আপনি?

উদ্যোক্তা ফেসবুকের জনক মার্ক জাকারবার্গ
উদ্যোক্তা ফেসবুকের জনক মার্ক জাকারবার্গ

ফেসবুকের জনক মার্ক জাকারবার্গ কোনো ঘোষণা দিয়ে উদ্যোক্তা হননি। তিনি তাঁর ক্লাসের কজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাসার গ্যারেজে বসে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। ক্লাসের লেকচারগুলো কীভাবে সহপাঠীদের সঙ্গে শেয়ার করা যায়, তার একটা উপায় উদ্ভাবনের উদ্যোগ নেন। ডিজিটাল পদ্ধতির একটা সুন্দর ব্যবস্থাও তাঁরা তৈরি করেন। কালক্রমে এর বিকাশ সাধন করেন। সেটাই আজকের ফেসবুক।

বিলাত-আমেরিকায় বেশির ভাগ তরুণই নতুন কিছু করতে চায়। সেখানে উদ্যোক্তা হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ তরুণই চায় চাকরি করতে। উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা সবার নেই।

এর কারণ কিছুটা প্রচলিত সামাজিক ধ্যানধারণা, আর কিছুটা তরুণদের উদ্যমের অভাব। ব্যবসার চেয়ে চাকরি ভালো, সম্মানজনক। আর ব্যবসা-বাণিজ্য করলে টাকার পেছনে ছুটতে হয়। ঘুষটুস লাগে। ওসব খারাপ। সে জন্যই আমাদের ঘোষণা দিয়ে বলতে হয়, আমি একজন উদ্যোক্তা হতে চাই। তার মানে এই না যে চাকরি করাটা খারাপ। কেউ চাকরি করবেন, কেউ উদ্যোক্তা হবেন। এই দুয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।

আমরা বুঝি না যে আগামী দিন উদ্যোক্তাদেরই। বিশেষভাবে এই ডিজিটাল যুগে একটা ল্যাপটপ নিয়ে টিএসসিতে বসে অনায়াসে একজন ভালো উদ্যোক্তা হয়ে যেতে পারেন আপনি। অথচ মাস্টার্স পাস করেও মাসের পর মাস ইন্টারভিউ দিতে দিতে আপনার স্যান্ডেলের তলা খসে গেছে, চাকরি জোটেনি। 

তবে উদ্যোক্তা হতে আপনার ভিশন থাকতে হবে। একটা স্বপ্ন। একাগ্র সাধনা। প্যাশন। থাকতে হবে জেদ। আর বিশেষভাবে দরকার আজকের যুগের জ্ঞানভিত্তিক চিন্তাভাবনা।
এই কথাগুলো বলছিলেন সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রথম আলোর একটি গোলটেবিল বৈঠকের অভিজ্ঞ আলোচকেরা। বিষয় ছিল ‘তরুণদের উদ্যোগ: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’। সেখানে তরুণ উদ্যোক্তারা এসেছিলেন। নীতিনির্ধারকেরাও ছিলেন। তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। চ্যালেঞ্জগুলোর কথা বলেছেন। আর বলেছেন তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে তৃপ্তির কথা।
বিশ্বের এক নম্বর জুমলা বেইজড কোম্পানি জুমশেপার–এর প্রধান নির্বাহী কাওসার আহমেদের বয়স এখন মাত্র ৩৪। ছাত্র অবস্থায় বিভিন্ন কারণে এক বছর তিনি পরীক্ষা দিতে পারেননি। কী করবেন দিশা পাচ্ছিলেন না। তিনি প্রোগ্রামিং শিখলেন। ফ্রিল্যান্স কাজ শুরু করেন। সফটওয়্যার তৈরি করতেন। একসময় শুরু করেন সফটওয়্যারের কপিরাইট বিক্রি। আয় বাড়তে থাকে। তাঁর সফটওয়্যার কোম্পানিতে এখন ৪০ জন কর্মী কাজ করেন।
শৈলি ক্রিয়েটিভ স্টুডিওর প্রধান তাহমিনা শৈলি অনলাইনে আইডিয়া বিক্রি করেন। ভাবতে পারেন, এটাও একটা পেশা? কিন্তু তিনি তো ভালোই করছেন। তাঁর তৈরি আধুনিক ডিজাইনের গয়না অনলাইনে বিক্রি হয়। তিনি বলেন, ‘একান্ত ইচ্ছা ছিল স্মার্ট একটা কিছু করব। করেছি।’ তাঁর মূল অভিজ্ঞতা হলো: টাকার পেছনে ছোটার দরকার নেই। কাজের পেছনে ছোটো, তাহলে টাকাই তোমার পেছনে ছুটবে।
কথাটা আক্ষরিক অর্থেই সত্য।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে মোট ১১টি রেস্তোরাঁর একটি চেইনশপের উদ্যোক্তা মনজুরুল হক। তিনি বেশ কয়েক বছর সিঙ্গাপুরে ছিলেন। সেখানে একধরনের রেস্তোরাঁ দেখেছেন, যেখানে তরুণেরা এসে গল্পগুজব করে। সময় কাটায়। খোলামেলা জায়গায় রেস্তোরাঁ তরুণদের খুব প্রিয়। সেখান থেকে ধারণা নিয়ে মনজুরুল হক চট্টগ্রামে রেস্তোরাঁ খুলে বসেন। খুব অল্প সময়েই নাম ছড়িয়ে পড়ল। এখন তো ঢাকায়ও।
মনজুর সাহেব মূলত জোর দিয়েছেন দুটি দিকে। প্রথমত, একটু খোলামেলা পরিবেশ। তরুণেরা আড্ডা দেবে। আর দ্বিতীয়ত, খাবারের মান। স্বাস্থ্যসম্মত ও ভেজালমুক্ত। সেখানে এখন ক্রেতার লাইন পড়ে যায়।
আমার মনে পড়ল বেশ কয়েক বছর আগে সানফ্রান্সিসকোর সান ডিয়েগোয় একটি রেস্তোরাঁর কথা। টুইগস কফিশপ। সেখানে নিরিবিলি পরিবেশে একটি রেস্তোরাঁয় লোকজন ল্যাপটপ নিয়ে আসেন। গল্প-কবিতা-উপন্যাস লেখেন। প্যারিস-লন্ডন থেকেও সেখানে ঔপন্যাসিকেরা আসেন। প্রতি উইকএন্ডে সন্ধ্যায় সেখানে কৌতুকের আসর বসে। সপ্তাহের নতুন পাঁচজন রম্যলেখক তাঁদের রচিত কৌতুক পড়ে শোনান বা অভিনয় করে দেখান। কী মজার, তাই না?
ঢাকায়ও প্রায় ৫০ বছর আগে এ রকম কয়েকটি রেস্তোরাঁ ছিল। পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারে ছিল মিরান্ডা রেস্টুরেন্ট। সেখানে কবি-সাহিত্যিকেরা যেতেন। সৈয়দ শামসুল হকও সেখানে বসতেন, লিখতেন। গল্পসল্প করতেন। নওয়াবপুরে ছিল ক্যাপিটাল রেস্টুরেন্ট। সেখানেও অনেক কবি-সাহিত্যিকের আসা–যাওয়া ছিল। কিন্তু ওগুলো ঠিক আজকের বারকোড রেস্তোরাঁর মতো ছিল না। একটু অন্য ধরনের উদ্যোগ ছিল। যা-ই হোক, উদ্যোক্তাদের একধরনের বিবর্তন ঘটেছে।
আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ২২-২৩ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে ঢুকছে। তাদের তো আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা করতে হবে। সবাই কি আর চাকরি পাবে। উদ্যোক্তা তো লাগবেই। তাহলে সেখানে অন্যদের চাকরি হবে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)–এর নির্বাহী পরিচালক কাজী আমিনুল ইসলাম বললেন, সরকার বিশেষ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে ১ লাখ উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। আমরা সেটাই চাই।
উদ্যোক্তাদের কিছু সহযোগিতার প্রয়োজন আছে। তাদের জানতে হবে দেশের আইনকানুন মেনে কীভাবে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়। ভ্যাট-ট্যাক্সের নিয়মকানুনও জানতে হবে। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একটি ইনোভেশন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউর বিভাগ আছে। ইউজিসির একটি বিশেষ উদ্যোগ দরকার। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের বিভাগ এখন খুব প্রয়োজন।
আসলে প্রতিটি তরুণের মধ্যেই উদ্যোক্তা হয়ে গড়ে ওঠার গুণ রয়েছে। কিন্তু ছোটবেলা থেকে আমাদের সমাজ ও পরিবার নানাভাবে নিরুৎসাহিত করে। আমাদের তরুণেরা খুব ভালোই জানে কীভাবে নতুন একটা কিছু শুরু করা যায়। অনেক সময় তেমন মূলধনও দরকার হয় না। ওরা জানে কোন ধরনের সেবা বা পণ্য উৎপাদন করলে তা বাজার পাবে। ডিজিটাল যুগে নতুন নতুন চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। সে বিষয়ে তরুণেরা ভালোই সচেতন।
শুধু দরকার তাদের উৎসাহ দেওয়া। তাহলেই তাদের বুদ্ধি খুলে যাবে। আজকের যুগে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করা তরুণদের জন্য ডালভাত।
আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]