'হোয়েন ইজ ইওর ইলেকশন'

লন্ডন থেকে বাসে অক্সফোর্ড ঘণ্টা দুয়েকের পথ। সিটি সেন্টারের অনেক আগেই ক্রাইস্ট চার্চ। সেখানেই অপেক্ষায় ছিলেন রাবেয়া দুরানি। আধা বাঙালি আধা পাঞ্জাবি এখন পাক্কা ব্রিটিশ। রাবেয়া ওঁর বাবার একটা কোট আর মাফলার এগিয়ে দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘দ্যাশের খবর কী? ভোট কি আর পিছাইবে?’ ব্রিটিশ কেতায় এসব পরের প্রশ্ন। চায়ের টেবিলে করা যায়। প্রথম দেখায় হাই-হ্যালো, কেমন আছো, আবহাওয়া কেমন? আজকে কি রোদ উঠবে? ইত্যাদি প্রশ্ন করার রেওয়াজ। রাবেয়া বাংলাদেশের ভোটার নন। তবু তাঁর তর সইছে না। আমরা হাঁটতে থাকি বোটক্লাবের দিকে, সেখানে অপেক্ষায় আছেন ফরিদ, আফরিন, ডেভিড, সুকান্ত, ময়না।

আমরা মিশেল বাংলায় কথা বলতে বলতে এগোচ্ছি। জনপ্রিয় পানশালা রকপুল বারের খোলা জায়গায় চা, কফি আর পিৎজা নিয়ে আড্ডায় মশগুল একদল বাদামি মানুষের মধ্য থেকে কে যেন চিৎকার করে বলে, ‘হোয়েন ইজ ইওর ইলেকশন, মাই ফ্রেন্ড?’ খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা। কলকাতা-ঢাকায় এ রকম অচেনা পথচারীকে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া কোনো ব্যাপার না, কিন্তু ইংল্যান্ডে অক্সফোর্ডে এ একেবারে রীতিবিরুদ্ধ কালচার। রাবেয়া জানতে চান, ‘তুমি কি উহাদিগকে চেনো? ডু ইউ নো দেম?’ আমারও একই প্রশ্ন রাবেয়ার কাছে। এর মধ্যে একজন ছুটে এসে আমার হাত ধরে জানতে চান, ‘ঢাকার থনে কবে আইসেন?’ বুঝল কেমনে আমি নতুন এখানে? ঢাকার টাটকা খবর আমার কোটের পকেটে। আরেকজন ভালোবেসে কোটের পকেটে থেকে উঁকি দিতে থাকা প্রথম আলোর সপ্তাহ খানেকের পুরোনো দুটো কপি হাত ঢুকিয়ে বের করে নেয়। আরও দুটো চেয়ার যোগ হয় তাঁদের টেবিলে। আমাদের বসতেই হয় কোট-মাফলার খুলে পিৎজার টেবিলে।

সবাই ঢাকার খবর, দ্যাশের খবর জানতে চান। নির্মলেন্দু গ‌ুণের সেই ‘হুলিয়া’ কবিতার মতো উৎসাহ সবার। আমি যেন কবিতায় কথিত হুলিয়া মাথায় করে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা এক ছাত্র। রাজধানীর খবর শোনার জন্য আমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি চলে হাওরের জনপদ বারহাট্টার ইয়াসিন, চরফ্যাশনের অদিত্য, কমলগঞ্জের আব্বাস আর বরকলের নিলাম চাকমার মধ্যে। সে দেশের তাজা খবর ব্রেক্সিটের মারপ্যাঁচ, তেরেসা মের থাকা না থাকা কিংবা ভারতীয় বংশোদ্ভূত মিতেশ প্যাটেলের বউকে খুন করে তাঁর ইনস্যুরেন্সের টাকা হাতিয়ে সমকামী বন্ধুর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ঘর বাঁধার চেষ্টার খবর ইত্যাদি কোনো কিছুতেই তাঁদের আকর্ষণ নেই। বাংলাদেশের ভোট ছাড়া যেন আর কোনো কিছুই ঘটছে না। সপ্তাহ কয়েক আগে যমুনার গহিন চরে এমন আপ্যায়ন পাওয়া যায়নি। অক্সফোর্ডের ছাত্র, শিক্ষক, চাকুরে, ব্যবসায়ী, বাংলাদেশের তামাম প্রবাসী কি টিভি দেখেন না! পড়েন না অনলাইনে দেশের পত্রপত্রিকা? আলাপে জানা যায়, তাঁরা দেখেন এবং পড়েন। তারপরও কেন এত প্রশ্ন?

বিশ্বাস যায় না, নিলাম চাকমা বলে বসেন। টক শো দেখেন, ঢাকার প্রায় সব কাগজ অনলাইনে পড়া যায় দূর প্রবাসে মুঠোফোনে বা ট্যাবে। তারপরও তাঁদের মনে হচ্ছে, আসল কথা জানা যাচ্ছে না। সেন্সরের ঘেরাটোপ পেরিয়ে সব খবর আসছে না। যেটা আসছে, সেটা সব নয়। এটা কি তাঁদের নিছক বাতিক না সত্যতা আছে তাঁদের অনুমানে। সে প্রশ্নও করেন একজন।

অক্সফোর্ডের কাউলি রোডের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী সুনামগঞ্জের আইয়ুব আলী (ছদ্মনাম) নিজেকে না লুকিয়ে বলেন, ‘আমিই জানতে চেয়েছিলাম, কবে হবে তোমাদের নির্বাচন? হোয়েন ইজ ইওর ইলেকশন?’ প্রায় ৪০ বছর আছেন ইংল্যান্ডে। রেস্টুরেন্টে কাজ করতে করতে এখন নিজেই গোটা চারেক পাব-রেস্টুরেন্টের মালিক। ছেলেমেয়েরা সেসব দেখাশোনা করেন সম্প্রতি। তিনি দাদা হয়েছেন, নানা হয়েছেন বছর দুয়েক আগে। নাতি-পুতিদের নিয়ে তাঁর দেশে যাওয়ার ইরাদা ছিল, টিকিটের বুকিং করেও আবার বাতিল করেছেন। সামনে নির্বাচন। কী জানি কী হয় দেশের পরিস্থিতি! নাম, সাকিন যা-ই হোক, সবারই মনে উঁকি দিচ্ছে এক আশঙ্কা, কী জানি কী হয়? আইয়ুব আলীর মতো অনেকেই এই শীতে দেশে বেড়াতে আসার চিন্তা বাদ দিয়েছেন। বাতিল করেছেন বিমানের বুকিং।

আইয়ুব আলী এখন ব্রিটিশ, কিন্তু তিনি বাংলাদেশের মানুষ। ৬২ বছরের প্রথম ১৮ বছর বাদ দিলে বাকি সবটুকু জীবন তাঁর কেটেছে বিলাতে। দেশে ফিরতে চান না, কিন্তু বছরে-দুই বছরে বেড়াতে যেতে চান। ফিবছরের কোরবানি এখনো দেশেই করান। নাতি-পুতির আকিকা, খতনা, বিয়েশাদি দেশে করাতে আগ্রহী। তারপরও কেন বলছেন, ‘ইয়োর ইলেকশন’, তোমাদের ভোট? দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে আগ্রহ আছে ষোলো আনা কিন্তু নিজস্ব বোধ বা ওনারশিপ নেই। তাঁদের কাছে দেশটা যেন সাজানো-গুছানো এক পর্যটনকেন্দ্র, নিরাপদ প্রমোদভ্রমণের জায়গা। সবার চোখে-মুখে দেশে এবার যেতে না পারার বেদনা। ‘যেতে না পারা’ না বলে ‘যেতে না চাওয়াটা’ বোধ হয় বেশি সত্যি।

ঢাকা থেকে কাতার হয়ে লন্ডন যাওয়ার উড়োজাহাজে একদল প্রবাসী শ্রমিক সহযাত্রী ছিলেন। তাঁদের কণ্ঠে ছিল অন্য বেদনা—ভোটের সময় দেশে থাকতে না পারার বেদনা। ছুটি শেষ, তাই চাইলেও থাকতে পারবেন না, সেটাই তাঁদের হায়-আফসোস। সারাটা পথ তাঁরা আলাপ করেছেন কে কোথায় জিততে পারে। উচ্চকণ্ঠের সেসব আলোচনায় নির্বাচন নিয়ে মানুষের আশাটাই বেশি মনে হয়েছে।

তবে কি বিলেতি ভাইদের আশঙ্কা একেবারে অমূলক? এঁরা যতই ব্রিটিশ হোন না কেন, প্রত্যেকের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে দেশের সঙ্গে। প্রায় প্রতিদিনই কথা হয় দেশ-গ্রাম থেকে যাওয়া ভাই-বেরাদারদের সঙ্গে। সব সূত্র থেকে তাঁরা যে খবর পাচ্ছেন, তাতে আশার চেয়ে আশঙ্কার গন্ধ বেশি। আশঙ্কার কতটা সত্য, কতটা ধারণা অথবা গুজব, সেটাই তাঁরা বুঝতে চান। টিভির টক শোগুলোর ভেতর তাঁরা যেন কেমন একটা টক টক গন্ধ পাচ্ছেন, পাচ্ছেন পেছন থেকে পাওয়া নির্দেশের আলামত। টক শোগুলো যেন দিন দিন ফাঁদে পরিণত হচ্ছে। ব্যক্তিগত কথাবার্তা কারা টেপ করে চ্যানেলগুলোয় পাঠিয়ে দিচ্ছে—এসব প্রশ্নের জবাব জানা নেই, কিন্তু জানতে তাঁরা চাইছিলেন বারবার।

বোটক্লাবের বন্ধুরা বারবার ফোন করছেন বলে আমাদের উঠতে হয়। হঠাৎ পাশের টেবিলে চায়ের পেয়ালা নিয়ে বসে থাকা এক তরুণ এক দাড়িওয়ালা ক্যামেরা পথিকের ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘তোমরা আর কত দিন তাঁকে আটকে রাখবে?’ তরুণটির সঙ্গে কথা হয় না। তিনি কি বাংলাদেশের? তিনি কি শহিদুল আলমকে চেনেন?

তাঁকে বলা হলো না, শহিদুল আলম অবশেষে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণকর্মী, গবেষক।