ওরে আমার বাংলা রে!

আমরা পয়লা বৈশাখে ন্যাশনালিস্ট, সারা বছর ইন্টারন্যাশনালিস্ট। এটা সবাই জানি। মানি না। মানে স্বীকার করি না। স্বীকার করলে ম্যালা ঝামেলা। তাই ‘বাঁয় বাঁচিয়ে ডাইনে রুখে’ চলি। কারণ, পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণের দিকটাও তো আমাদেরই সামাল দিতে হয়!

আমাদের একতারার দরকার আছে, সাথে গিটারটাও দরকার। লোকগান না হলে চলে না। কিন্তু অনুষ্ঠানটার নাম যদি হয় শুধু ‘লোক উৎসব’, তার সাথে ‘ফোক ফেস্ট’ –জাতীয় কোনো ইংরেজি সাবটাইটেল যদি না থাকে, তাহলে আর মুখ দেখানোর জো থাকে না। সেখানে পল্লিগীতি হতে পারবে, লালন হতে পারবে, ভাওয়াইয়াও চলতে পারে। কিন্তু তার সাথে শুধু হারমোনিয়াম, ডুগি–তবলা, একতারা বাজবে, সেটা তো কোনো কাজের কথা হলো না।

কনফিউশানের যুগে ফিউশন অবধারিত। অনিবার্য। দেশি খোল–তবলার সাথে পশ্চিমা মেটালিক আর ইনস্ট্রুমেন্টাল সিম্ফনি লাগবেই। বাংলা উচ্চারণেও ফিউশন আনতে হবে।

একেবারে আদি এবং ঝরঝরে বাংলা উচ্চারণটা এখনকার ফোকের সাথে ঠিক যায় না। চেষ্টা করে উচ্চারণ বিকৃত করা বা একটু ব্যাঁকা ত্যাড়া বাংলা বলা দরকার। তা না হলে স্রেফ ‘ফকিরি বাংলা’ হয়ে যাবে। বটতলার প্রমিত বাংলা উচ্চারণের দিন শেষ।

ভারতের সিনেমা সমালোচক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের একটা ভাষণ শুনছিলাম। উনি বলছিলেন, আমরা বাংলা ভাষাটাকে একটা অসম্মানের যোগ্য ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছি। বিত্তের সঙ্গে অ-বাংলার, মানে ইংরেজির এবং দারিদ্র্যের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক বেশি, এ কথা কেউ আমাদের শিখিয়ে দেয়নি। কিন্তু আমরা জানি ওটাই সত্যি। আমরা মনে করি, জাতে উঠতে হলে আমাদের খাওয়াদাওয়া, ওঠা–বসা থেকে শুরু করে বাথরুমে যাওয়া পর্যন্ত ইংরেজির একটা টাচ থাকতে হবে। আমাদের মাথার ভেতরে খুব ভালো করে ঢুকে গেছে ইংরেজির সঙ্গে একটা সপ্রতিভ, একটা সমৃদ্ধ, একটা সম্ভাবনাময় জীবনযাপন ও মনোভঙ্গির সরাসরি সমীকরণ আছে। আর বাংলা ভাষার সঙ্গে একটা অপ্রতিভ, এঁদো, ছেঁদো ও বদ্ধ দারিদ্র্যমার্কা জীবনের সম্পর্ক আছে।

ধরুন আপনি ঝকঝকে একটা শপিং মলে গেলেন। খুব নামী ব্র্যান্ডের দোকানে ঢুকবেন। কাচের দরজায় লেখা দেখবেন ‘পুশ’। আপনি পুশ করে, মানে ঠেলা দিয়ে ফুস করে ভেতরে ঢুকলেন। খুব সুন্দর পোশাক পরা তরুণ বা তরুণী আপনার দিকে এগিয়ে আসবে। কী ভাষায় কথা হবে আপনাদের মধ্যে? আপনি ইংরেজি জানুন আর না জানুন, কথা হবে ইংরেজি আর বাংলা মিলিয়ে ঝিলিয়ে। ‘গুড মর্নিং’ টাইপের কিছু টুকটাক সম্ভাষণ করবেন তাঁরা। কোনো পণ্যের গায়ে যেখানে দাম লেখা থাকে, সেটার নাম যে ‘প্রাইস ট্যাগ’ সেটা আপনি এমনিতেই জানেন। তবু ওদিকে হাত বাড়িয়ে বিক্রয়কর্মীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন। তিনি আপনাকে বলতেই পারেন ‘স্যার, ওটার দাম আট শ টাকা।’ কিন্তু তা তিনি বলবেন না। তিনি বলবেন, ‘এইট হান্ড্রেড, স্যার!’ কারণ তাঁকে চাকরি দেওয়ার সময় বলেই দেওয়া হয়েছে, খদ্দেরের সাথে কথা বলার সময় যতটা পারা যায় ইংরেজি ছোঁয়া রেখে যেতে হবে। বড় রেস্টুরেন্টে ঢুকে আপনি ওয়েটারের কাছে যতবার লবণ চাইবেন, তিনি ততবার আপনাকে ‘সল্ট’ এনে দেবেন। কেন? কারণ, কর্তৃপক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া আছে, এই রকমের একটা বৈভবময় জায়গায়, যেখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষার উদ্‌যাপন হয়, সেখানে তুমি তোমার ক্রেতার সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে পারো না। কারণ, ইংরেজি অভিজাতদের ভাষা এবং বাংলা অনভিজাতদের ভাষা। এফএম রেডিওতে কর্তৃপক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া আছে, তুমি একটানা শুদ্ধ ঝরঝরে উচ্চারণে বাংলায় কথা বলে যাবে না। তুমি বাংলা উচ্চারণের মধ্যে ইংরেজি উচ্চারণের মতো একটা দ্যোতনা তৈরি করবে এবং ‘বাই দ্য বাই’, ‘অসাম’, ‘এনিওয়ে’, ‘হাউএভার’ টাইপের শব্দ ঢুকিয়ে একটা জগাখিচুড়ি মার্কা উচ্চারণে কথা বলবে। সেই নির্দেশের কারণেই একজন রেডিও জকি বাংলাটাকে বেঁকিয়ে –চুরিয়ে এমনভাবে বলেন, যেন মনে হয় উনি এই কিছুদিন হলো বাংলায় কথা বলা প্র্যাকটিস করছেন। মনে হবে, উনার নানার বাড়ি ওয়েলিংটন, দাদার বাড়ি কাউয়ারচর। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, উনার দাদার নাম কফিল উদ্দিন ব্যাপারী বা ইদরিশ আলী মাতুব্বর। সেই কফিল উদ্দিন, আফিল উদ্দিনের নাতিপুতিরা বাংলা-ইংরেজি গুলিয়ে আমাদের দিকে গুগলি ছুড়তে থাকেন।

কারণ, এই ভাঙা বাংলা, ব্যাঁকা বাংলা, না পারা বাংলা হলো আভিজাত্যের প্রতীক। আমরা জেনে গেছি, যে লোকটা চোস্ত ইংরেজি বলে তার ভাবনা, চলা চলতি, খাওয়া, ঘুমানো, বাথরুমে যাওয়া—সব উঁচু জাতের। আর যে শুধু বাংলা বলে, তার ইংরেজি বলার মুরোদ নেই বলেই সে শুধু বাংলা বলে। এই শুধু বাংলা বলতে পারার মধ্যে যে কী নিদারুণ অপমান, তা প্রতিনিয়ত পুঁজিবাদী করপোরেট বিশ্ব আমাদের শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

‘আমার সোনার বাংলা’র এই দশা কেমন করে হলো? গ্রন্থিকেরা যা-ই বলুন, আমি বলব, এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছে একটা হাওয়া। সেটা পরিবর্তনের হাওয়া। সেই যে বছর ‘হাওয়া হাওয়া’ গানটা আমদানি হলো, তখনই এই পরিবর্তনের হাওয়াটা গায়ে লেগেছিল।

রাজনীতির রাজপথ থেকে সাহিত্যের কানাগলি-সবখানে এখন ‘পরিবর্তন’ জিনিসটা দস্তুরমতো ডিমান্ড। নিখিল বঙ্গে যার নাম ‘পরিবর্তন’, সাহেবদের কাছে তা ‘চেঞ্জ’। আরব দেশেও নিশ্চয়ই এই জিনিসের কোনো একটা গালভরা নাম আছে। ‘আরব বসন্ত’ দেখে অন্তত তাই মনে হয়।

ওপার বাংলার তৃণমূলের দিদি থেকে ‘আমেরিকার বাবা-মা’ ওবামা—সবাই ‘পরিবর্তন’ আর ‘চেঞ্জ’–এর কাঁধে ভর করে এসেছেন। আমরাও এখন একটি চেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সিজন চেঞ্জের সময় সর্দিকাশি হয়। আমাদেরও হচ্ছে। ভয়ের কিছু নেই। ডাক্তার তো বলেই দিয়েছেন, ‘প্যারাসিটামল তিন বেলা!’

সারফুদ্দিন আহমেদ: সাংবাদিক