মহাকাল নেবে ধ্বংসের শোধ

ক্ষুধা-অপুষ্টির কারণে মৃত্যুর মুখে থাকা ইয়েমেনের অসহায় শিশুদের এমন অসংখ্য ছবি এখন গণমাধ্যমে ঘুরছে। ছবি: সেভ দ্য চিলড্রেন
ক্ষুধা-অপুষ্টির কারণে মৃত্যুর মুখে থাকা ইয়েমেনের অসহায় শিশুদের এমন অসংখ্য ছবি এখন গণমাধ্যমে ঘুরছে। ছবি: সেভ দ্য চিলড্রেন

ছোটবেলায় জয়নুলের চিত্রকর্ম দেখে দুর্ভিক্ষের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়। বিশেষ করে কঙ্কালসার শিশুদের দেখে কচিমনের ভেতর কেমন যেন হু হু করে উঠেছিল।

আসলে মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে গিয়েছিল। দুর্ভিক্ষ! মানে—কোনো খাবার থাকবে না। ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে। কী ভয়াবহ, কী কঠিন সেই পরিস্থিতি!

স্রষ্টার কাছে মিনতি করেছি। হে খোদা, হে আল্লাহ, কোনো দিন যাতে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে না হয়। কোনো দিন যাতে এই দেশে কিংবা কোথাও বুভুক্ষু মুখ দেখতে না হয়।

শৈশব পেরিয়ে কৈশোর, তারপর তারুণ্য। দুর্ভিক্ষকে তত দিনে নানান তত্ত্বের চুলচেরা বিশ্লেষণে চেনার সুযোগ।

বিশ্বব্যাপী কথিত উন্নয়নের ডামাডোলে দুর্ভিক্ষের কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। কিন্তু বৈষম্য, অন্যায়-অবিচার, যুদ্ধবিগ্রহের পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ হারিয়ে যাওয়ার নয়। জয়নুলের দুর্ভিক্ষের চিত্রকর্মের অভুক্ত শিশুরা এই পৃথিবীতে ফের ফিরে এসেছে।

এবার ঘটনাস্থল বাংলা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেন।

শনির দশা যাকে বলে, তা অতীতেও ইয়েমেনের পিছু ছাড়েনি, এখনো না। আরব বসন্ত ইয়েমেনে পৌষ মাসের বদলে সর্বনাশ ডেকে আনে।

২০১১ সালের শুরুতে ইয়েমেনে আরব বসন্তের ঢেউ লাগে। কিন্তু ইয়েমেনিদের স্বপ্নের বসন্তের ফুল আর ফোটেনি। দিন দিন দেশটিতে অস্থিরতা-সংঘাত শুধু বেড়েছেই। ইয়েমেন এখন এক ধ্বংসপুরী, যেখানে ক্ষুধা, রোগ ও শোকেরা আপন মনে উদাম নৃত্য করে। ইয়েমেনের বর্তমান পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাকে বিশ্বের সবচেয়ে বাজে মানবসৃষ্ট মানবিক সংকট বলে অভিহিত করেছে জাতিসংঘ।

আরব বিশ্বের দরিদ্রতম দেশ ইয়েমেনে আরব বসন্তের জেরে ক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে লড়াই চলে আসছিল। ২০১৫ সালের মার্চে ইয়েমেনে সামরিক হস্তক্ষেপ করে সৌদি আরব। মানসুর হাদির বৈধ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে ইরানপন্থী হুতিদের বিরুদ্ধে গোলা ছুড়তে শুরু করে সৌদি। রিয়াদের বদান্যতায় বিষফোড়া প্রাণঘাতী ক্যানসারে রূপ নিয়েছে।

ইয়েমেনে এখন মৃত্যুরা অবাধে বিচরণ করে। কয়েক বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হাজারো প্রাণ নিভে গেছে। আহতও হাজারে হাজারে। হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নিরীহ, সাধারণ মানুষ।

দেশটিতে চলমান সংঘাতের সবচেয়ে বড় শিকার শিশুরা। গুলি, গোলা, বোমায় অকাতরে শিশুদের প্রাণ যাচ্ছে। যেসব শিশু বেঁচে আছে, তাদের অবস্থাও যায় যায়। ক্ষুধা, রোগ, অপুষ্টি ইয়েমেনি শিশুদের অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরেছে।

গত বছরের নভেম্বরে সেভ দ্য চিলড্রেন বলেছিল, তীব্র ক্ষুধা ও রোগে ইয়েমেনে দিনে গড়ে ১৩০ জন শিশু মারা যাচ্ছে। একই সংস্থা সম্প্রতি জানায়, যুদ্ধের কারণে গত তিন বছরে ইয়েমেনে তীব্র অপুষ্টিতে ভুগে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৮৫ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।

ইয়েমেনে শিশুদের মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, দেশটিতে মানবিক ত্রাণ সহায়তার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা লোকের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। যুদ্ধ ও অবরোধের ফলে ত্রাণ পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রায় দেড় কোটির মতো মানুষ (অর্ধেক শিশু) দুর্ভিক্ষের মুখে। কলেরাসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি মহামারির মতো ছড়াচ্ছে। এই দুর্বিষহ সংকটের অসহ্য চাপ শিশুদের ওপর দিয়েই বেশি যাচ্ছে। ‘ভালনারেবল’ হওয়ায় তাদেরই বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে।

ইয়েমেনি শিশুদের জন্য দুর্ভাগ্য। পরিস্থিতির আশু অবসানের কোনো লক্ষণ নেই।

জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধে বারবার আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙছে না। ক্ষমতার কাছে, স্বার্থের কাছে মানবিকতা বেদম মার খেয়ে যাচ্ছে।

মাস কয়েক আগে ইয়েমেনে স্কুলবাসে সৌদির বিমান হামলায় ৪০ শিশু নিহত হয়। এই ঘটনার পর শিশুদের ছোট ছোট কবরের সারি বিশ্বের বিবেকবান মানুষের চোখে জল এনেছিল। কিন্তু তাতে যুদ্ধের মূল হোতাদের হৃদয় একটুও গলেনি। রক্ত যতই ঝরুক, শিশুরা যতই মরুক, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ইয়েমেনের শেষ দেখেই ছাড়বেন।

ক্ষুধা-অপুষ্টির কারণে মৃত্যুর মুখে থাকা ইয়েমেনের শিশুদের অসংখ্য ছবি এখন গণমাধ্যমে ঘুরছে। সব শিশুরই চোখ গর্তে ঢুকে গেছে। তাদের দুই ফ্যাকাশে চোখে অসহায় চাহনি। শুষ্ক মুখে অব্যক্ত যন্ত্রণা। তাদের হাড্ডিসার শরীরে প্রাণের ক্ষীণ স্পন্দন। এই দৃশ্যেও যদি কথিত বিশ্বনেতাদের, মানবতার সোল এজেন্টদের না পোড়ে বোধ, একদিন মহাকাল নেবে ধ্বংসের শোধ।

সাইফুল সামিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]