বিএনপি নেতৃত্বের বৈধতার প্রশ্ন

গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা বাদ দিয়ে বিএনপি যে সংশোধনী দিয়েছিল, সে বিষয়ে হাইকোর্টের দেওয়া দুটি নির্দেশনাই কার্যকর করেছে নির্বাচন কমিশন। এ বিষয়ে তারা তাদের সিদ্ধান্ত বিএনপি এবং দলটির গঠনতন্ত্র সংশোধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জকারী ব্যক্তিকে চিঠি দিয়ে অবহিত করেছে। এর ফলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বের বৈধতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধই থাকছে। তবে বিষয়টি সাব জুডিস বা বিচারাধীন হয়ে পড়ায় তাঁরা সম্ভবত আপাতত উদ্বেগমুক্ত।

বিএনপির গঠনতন্ত্রে ৭ নম্বর ধারায় ‘কমিটির সদস্যপদের অযোগ্যতা’ শিরোনামে বলা আছে, ‘নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যেকোনো পর্যায়ের, যেকোনো নির্বাহী কমিটির সদস্যপদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীপদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’ তাঁরা হলেন: (ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি। (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি, (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি। গত জানুয়ারিতে তারা এ ধারাটি বাদ দিয়ে ইসিতে গঠনতন্ত্রের সংশোধনী জমা দিয়েছে।

এ নিয়ে আমরা কথা বলি নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, ‘হাইকোর্টের গত ৩১ অক্টোবরের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে রিটকারী ব্যক্তির ইতিপূর্বে ইসিতে জমা দেওয়া দরখাস্ত এক মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি এবং বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত গ্রহণ না করতে নির্দেশনা ছিল। আমরা এই দুটি বিষয় একত্রে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা সংশ্লিষ্ট পক্ষকে অবহিত করেছি।’ তবে তাদের সর্বশেষ সিদ্ধান্তের ফলে বিএনপির নেতৃত্বের বৈধতার বিষয়টি কীভাবে ইসি দেখবে, সে বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। এ নিয়ে সংক্ষিপ্ত কথা হয় নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের সঙ্গেও। তাঁর যুক্তি: এ বিষয়ে হাইকোর্ট যে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়া তিনি সমীচীন মনে করেননি। তাই তাঁরা এ বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশ দ্রুততার সঙ্গে বলবৎ করেছেন। বিষয়টি হাইকোর্টে গড়ানোর প্রেক্ষাপট বেশ মজার। দেখা গেল বিএনপির ‘নিষ্ঠাবান কর্মী’ হিসেবে একজন মোজাম্মেল হোসেনের আবির্ভাব। বিএনপির ওই অন্যায্য সংশোধনী তাঁকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তিনি ইসিকে তা গ্রহণ না করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ইসি কোনো সিদ্ধান্ত না দিলে তিনি রিট করেন।

রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র মানে হলো দলের সংবিধান। দেশের সংবিধান নিয়ে আমরা মামলা ও রায় পেয়েছি। কিন্তু দলের সংবিধানের বৈধতা আদালতে যাওয়ার ঘটনা এই প্রথম। গত ৩১ অক্টোবর বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন এক আদেশ দেন। এই আদেশে উল্লিখিত দুটি শর্ত ছিল। ‘বিএনপির নেতৃত্ব হারাচ্ছেন খালেদা-তারেক?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘এখন নির্বাচন কমিশন আদালতের কথা বলে সংশোধনী গ্রহণ করবে না। গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা বাদ দিয়ে বিএনপি নিজেই নিজের ফাঁদে পড়েছে।’ কিন্তু ফাঁদে পড়ার সঙ্গে ভিন্নমত দিয়েছেন বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী কায়সার কামাল। তিনি হাইকোর্টের আদেশের অনুলিপি বা ইসির চিঠি কোনোটিই পাননি বলে দাবি করেন। আর যুক্তি দেন যে, ‘হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ অকার্যকর। কারণ, ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি বিএনপির কাউন্সিলে অনুমোদিত বিএনপির গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই “রিসিভ” করেছে। আইন অনুযায়ী ইসি বিএনপির সংশোধনী যে তারিখে গ্রহণ করেছে, সেই তারিখেই তা কার্যকর হয়েছে। এ কারণে হাইকোর্টের আদেশের কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকে না।’ তাঁর দাবি, ‘এটা বিএনপি ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ।’ আমরা বলি, এই রিটটির নিষ্পত্তি একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়। কারণ, এটি দেশে নতুন একটি বিচারিক নজির স্থাপন করল। সংক্ষুব্ধ নাগরিকেরা এখন দলের সংবিধানের গণতন্ত্রচর্চা, বিশেষ করে মনোনয়ন দেওয়ার প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সক্ষম হবেন। ইতিমধ্যে দলীয় সংবিধান প্রশ্নে রুল জারি এবং অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ নতুন উদাহরণ তৈরি করেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নির্বাচন কর্মকর্তারা বলেছেন, বিএনপি যেটা ভুল করছে সেটা হলো, ‘রিসিভ’ করা আর ‘অ্যাকসেপটেন্স’-এর ফারাক আমলে না নেওয়া। ইসি তাদের সংশোধনী রিসিভ করেছে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সেটা ইসি অনুমোদন করেছে। তাদের কাছে জানতে চাই, এই অ্যাকসেপটেন্স তাঁরা কোন ধারায় করবেন, তখন তাঁরা নীরব থাকেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনী পরিচালনা বিধিমালা বা ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংবিধান পরিপন্থী হলে দলীয় নিবন্ধন বাতিল বা নিবন্ধন না দেওয়ার অধিকার আছে ইসির। কিন্তু নিবন্ধনকালে বা তার পরে নিবন্ধিত সংগঠনের গঠনতন্ত্র বা তার সংশোধনী ইসি কর্তৃক অনুমোদনের বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায় ঘোষণার ১০ দিন আগে ৭ নম্বর ধারা বাদ দিয়ে বিএনপি সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। কিন্তু কোনো ধারার আওতায় এটা জমা দিতে তাদের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়।

এখানে দুটি দিক আছে। কেউ অনুমান করতে পারেন যে, বিএনপি দণ্ডিত থাকার বিধান বাদ দিয়েছে না বুঝেই। কেন এমন মনে হলো, আসুন, খতিয়ে দেখি। পত্রিকায় পড়েছি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এর আগে বলেছেন, ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ৮ নম্বর আদেশ (রাষ্ট্রপতির ৮ নম্বর আদেশটি দালাল আইন নামে পরিচিত) ইতিমধ্যে বিলোপ হয়েছে। তাই বিএনপির গঠনতন্ত্রে এটি রাখার কার্যকারিতা নেই। এটা তিনি বলে থাকলে সেটা তথ্যগত ভুল। কারণ, আইনটি ২০১১ সালে পুনরায় সংবিধানের তফসিল দ্বারা পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। আর জিয়াউর রহমানের বাতিল আইনটিও একটি পূর্ণাঙ্গ আইন হিসেবে টিকে আছে। সেখানে বলা ছিল, ইতিমধ্যে যারা দণ্ডিত (প্রায় আট শ ছিল), তাদের ক্ষেত্রে মূল আইনটি অনাদিকাল বলবৎ থাকবে। এর প্রমাণ হলো, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে দালাল আইনে দণ্ডিতদের অযোগ্য হওয়ার বিধানটি ৪৭ বছর ধরে একটানা কার্যকর আছে।

দালাল আইন নামে পরিচিত রাষ্ট্রপতির ৮ নম্বর আদেশটির শিরোনাম ছিল, ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ। অনেকেরই এটা জানা নেই যে পঞ্চম সংশোধনীতে শর্ত সাপেক্ষে বাতিল করা হয়েছিল। বিএনপির গঠনতন্ত্রে এটা থাকা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের একটি অবস্থান বলে দাবি করার মতো বিষয় ছিল। তবে আমরা অনুমান করি, দুর্নীতির মামলায় ‘দণ্ডিত’ শীর্ষ নেতারা ‘সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ’বলে নেতৃত্বে অযোগ্য বিবেচিত হতে পারেন—এই ভয় থেকে তারা হয়তো পুরো সংশোধনীটি বাদ দিয়েছে। সমাজের চোখে কে ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ ও ‘কুখ্যাত’, সেটা যেকোনো দলের নীতিনির্ধারণী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মন্ত্রিত্ব তার উদাহরণ। প্রশ্নটি নৈতিকতার, আইনি নয়।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ খ ধারায় দলের বৈধতা টেকানোর আরও অনেক শর্তাবলি আছে। এতে বলা আছে, দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব স্তরের সবাই ‘নির্বাচিত’ থাকবেন। ২০২০ সালের মধ্যে সর্বস্তরের কমিটিতে নারীর ৩০ শতাংশ কোটা থাকবে। পেশাজীবীদের মধ্যে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন থাকবে না। দলের সংবিধান অনুযায়ী ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা, উপজেলা বা জেলা কমিটির তৈরি করা প্যানেল বিবেচনা করেই কেন্দ্রীয় বোর্ডের মনোনয়ন ঠিক করার কথা। তা যে এবার মানা হলো না, তার প্রতিকার কী হবে?

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]