এমন নির্বাচনই ইসি চায়?

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী নির্ধারণের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। আওয়ামী লীগ রোববার প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। ঐক্যফ্রন্টসহ অন্য দলগুলোও আজকালের মধ্যেই তালিকা প্রকাশ করবে। নির্বাচন কমিশনও ব্যস্ত। 

প্রতিদিনই কমবেশি বিভিন্ন নির্দেশ জারি করে বক্তব্য দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন: এই করা যাবে, সেই করা যাবে না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, ভিডিও করা যাবে না, সরাসরি সম্প্রচার করা যাবে না। এর মানে কি কোনোও কারচুপি দেখলেও ঠোঁট বন্ধ করে রাখতে হবে? নির্বাচন শেষেই কেবল মুখ খোলা যাবে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে যাবে। বিভিন্ন কারণে নির্বাচনকে ঘিরে ঠিক উৎসবের আমেজ নেই।

স্বতঃস্ফূর্ততা, উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে সর্বত্রই যেন একধরনের অনিশ্চয়তা, শঙ্কা ও ভয় বিরাজ করছে। শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্ট কি নির্বাচনে থাকবে বা থাকতে পারবে? নির্বাচন কমিশন (ইসি) কি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে? পরিচিতজনদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, নির্বাচন কেমন হবে? প্রায় সবাই আমতা-আমতা করে বলেছেন, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়। কেউই জোর গলায় বলেননি, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। বরং অনেকেই শঙ্কা করছেন, শেষ পর্যন্ত একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত নাও হতে পারে। বিগত কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আচরণ এবং সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা জনসাধারণের মনে খুব বেশি আশা জোগাচ্ছে না।

যেমন নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যেই বুড়িগঙ্গায় ভেসে উঠেছে যশোর থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী আবু বক্করের দেহ। আবু বক্কর মনোনয়নের জন্য দলীয় সাক্ষাৎকার দিতে এসেছিলেন। এরপর তাঁকে পাওয়া যায় বুড়িগঙ্গায়। তিনি এখন সবকিছু ঊর্ধ্বে। মনোনয়ন পাওয়া-না পাওয়ার আনন্দ-হতাশা তাঁকে আর স্পর্শ করবে না। কিন্তু আবু বক্করের হত্যাকাণ্ড অন্যদের শঙ্কিত করতে পারে। এমন সময় আবু বক্করকে অপহরণ করা হয়, যখন বিরোধী মতকে মাঠে দাঁড়াতেই দেওয়া হচ্ছে না। অপহরণ, জেল, আটক, হামলা, মামলায় বিরোধী দল এখন জেরবার। এরা এখন আদালত প্রাঙ্গণেই দৌড়াদৌড়ি বেশি করছে। ভোটের মাঠে যাওয়ার সময় কই?

রাজধানী বা মফস্বল—সব জায়গাতেই একই রকম ধাওয়ার ওপরে আছেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। সম্প্রতি ভৈরব পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চণ্ডিবের গ্রামে বিএনপির উদ্যোগে কর্মিসভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকজন হামলা করে সভা ভন্ডুল করে দেয়। পুলিশের উপস্থিতিতেই বিএনপির কর্মীদের মারধর করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। কর্মিসভা আয়োজনকারী একজনের ভৈরব বাজারের রেস্টুরেন্টেও রাতের বেলায় ভাঙচুর করা হয়। যশোরের অভয়নগরেও বিরোধী নেতা-কর্মীদের সভায় পুলিশ লাঠিপেটা ও গুলিবর্ষণ করে ভন্ডুল করে দেয়। এ রকম অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে সারা দেশে। তফসিল ঘোষণার পরও বিরোধী দলকে বৈঠক পর্যন্ত করতে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু বিপরীতে মহাজোটের নেতা-কর্মীরা কিন্তু নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করছেন।

মাঠপর্যায়ে বিরোধী কর্মীদের হামলা-মামলায় ব্যস্ত রাখার পাশাপাশি নতুন পর্যবেক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তাদেরও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও কি পর্যবেক্ষকেরা বলতে পারবেন যে ভোট খুবই ভালো হচ্ছে? বা ঐক্যফ্রন্টের লোকজন যদি কোনো কেন্দ্র দখল করে বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের মতো জাল ভোট দেওয়া শুরু করে, ব্যালটে আগেই সিলে দিয়ে এনে বাক্সে ঢোকানোর চেষ্টা করে বা হাঙ্গামা করে, তাহলেও কি পর্যবেক্ষকেরা কোনো মতামতই দিকে পারবে না? কোনো মৃত ব্যক্তির ভোট দেওয়ার মতো অশরীরী ও অলৌকিক ঘটনা দেখা গেলেও কি মূর্তির ভান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। প্রতিবেদন দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? ইসি পরিষ্কার করে বলে দিলে ভালো হতো কোন কোন দলের কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষকদের কী কী আচরণ করতে হবে? কারণ, নির্বাচনে নানা দল অংশ নেবে। দল অনুযায়ী মতপ্রকাশের ধরন ঠিক করে দিলে ভালো হয় আরকি।

ইসি কেন গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের কর্মতৎপরতা সীমিত করতে চায়? নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হলে অবাধ প্রচার নিয়ে কোনো সমস্যা থাকার কথা ছিল না। বরং কেন্দ্রে পর্যবেক্ষকদের চলাফেরা সীমিত করে ফেলা হলে বা প্রযুক্তির সুবিধা না থাকলে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়তে পারে। অবশ্য নির্বাচনের দিন সারা দেশে মুঠোফোন তরঙ্গ বন্ধ করে দেওয়া হবে কি না, সে সম্পর্কে ইসি এখনো কিছু জানায়নি। ইসিও নিশ্চয়ই একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে দ্বিমত করবে না। তবে কেন এত রাখঢাক করতে চাইছে?

নির্বাচনে সম্ভাব্য দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের টেলিফোন করে খোঁজখবর নিয়েছে পুলিশ। গোপনে না। বরং বিষয়টি উল্টো। টেলিফোনে পরিবারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে এমন কোনো আইন আছে কি না, কোনো পরিবারের কেউ রাজনীতিতে যুক্ত থাকলে ওই সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। যদি এমন কোনো আইন থেকে থাকে, তবে বিগত নির্বাচনগুলোয় অনেক সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাই নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে পারতেন না। কারণ, তাঁদের অনেকরই স্বামী, স্ত্রী, আত্মীয়–পরিজন রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।

এটা হঠকারী ও ভুল নীতি। কারও কোনো রাজনৈতিক সমর্থন বা সংশ্লিষ্টতা থাকলে পুলিশের কাছে টেলিফোনে স্বীকার করবে বলে মনে হয় না। বরং এতে করে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। সমাজে নানা ধরনের গুজবের সৃষ্টি হবে। সম্ভাব্য নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অনেকেই মনে করতে পারেন যে নির্বাচন কমিশন তাদের যথাযথ নিরাপত্তা দিতে পারছে না। এই শঙ্কার জায়গা থেকেই অনেকে পারিবারিক কারণ দেখিয়ে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে চাইছেন না। ইতিমধ্যেই তাঁরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জমা দিয়েছেন। এটা সত্যি হয়ে থাকলে বোঝাই যাচ্ছে, নির্বাচনকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কার মেঘ তৈরি হচ্ছে।

কিন্তু শুরুতে প্রতিটি দলই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর দেশের নাগরিকেরা নড়েচড়ে বসেছিলেন। ঐক্যফ্রন্ট ঘোষণা দিয়েছে যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে থাকার। সর্বশেষ নির্বাচন ঐকফ্রন্টের দলগুলো বর্জন করেছিল। এবার নির্বাচন করতে চাইছে। অবস্থানের পরিবর্তন হতেই পারে। রাজনীতিতে কখনো এক পা এগোলে সময়ে আবার কয়েক পা পেছাতেও হয়। ঐক্যফ্রন্টের দলগুলো গতবার পৃথকভাবে এক পা পেছালেও এবার সম্মিলিতভাবে কয়েক পা এগিয়েছে। কিন্তু এবার এগিয়ে এলেও তাদের চাপের মধ্যে রাখা হচ্ছে। সব মিলিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে নিয়ে কোথায় যেন একটু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

এক নজিরবিহীন নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে দেশ। যদি রাজনৈতিক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তা খুবই নজিরবিহীন এক ঘটনা হবে। কারণ, বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের নজির নেই। আর যদি শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে না থাকে এবং তাদের হামলা, মামলা, ভয়ভীতি দেখিয়ে নির্বাচন থেকে বের করে দেওয়া হয়, সেটাও হবে নজিরবিহীন। কারণ, বাংলাদেশে এর আগে নির্বাচনে ইচ্ছুক কোনো দলকে এভাবে হামলা, মামলা ও ভয় দেখিয়ে নির্বাচন থেকে বের করে দেওয়া হয়নি।

ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন