বাদল-দিনের প্রথম কদম হেমন্তে কেন?

বাংলাদেশের প্রকৃতিকে দুজন খুব ভালোভাবে জেনেছেন ও সবাইকে জানিয়েছেন। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে দেখেছেন এবং চিনিয়েছেন ঘেঁটু ফুলের সৌন্দর্য ও বসন্তবাউরি পাখির বাহার। বিহারের বিশাল বনাঞ্চলের দেখভাল করার অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর লেখা ‘আরণ্যক’ আমি বহুবার পড়েছি। এখন জীবনের সায়াহ্নে এসেও পড়ে শিহরিত হই, যেমন ক্লাস সেভেন কি এইটে প্রথম পড়ার সময় হয়েছিলাম।

আরেকজন যিনি প্রকৃতিকে তাঁর অনবদ্য ভাষায়, গানে ও কবিতায়, আমাদের রোজই চেনাচ্ছেন তিনি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তিনি যখন লেখেন ‘কদম্বেরই কানন ঘেরি আষাঢ় মেঘের ছায়া’ তখন সঙ্গে সঙ্গে আরও মনে পড়ে যায় ‘বাদল দিনে প্রথম কদম ফুলে’র কথা। বর্ষার পরে আসে শরৎ। তখন আরও দুটি গান মনে গুনগুনিয়ে ওঠে, ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচরি খেলা’। আরও গাইতে ইচ্ছে করে ‘ওলো শেফালি, ওলো শেফালি’। শরতের পরে আসে হেমন্তলক্ষ্মী তার সোনা রঙের পাকা ধানের সম্ভার নিয়ে।

যাঁরা মনে করছেন আমি বাংলাদেশের প্রকৃতির মোহন রূপের বন্দনা করছি, তাঁরা খানিকটা আমার মনের কথা বুঝলেও পুরোটা সম্ভবত বোঝেননি। আমার অন্য ভাবনাটি হলো, এই মোহন রূপ আর কত দিন থাকবে? আমরা কি ২০/৩০/৪০ বছর পরও গাইতে পারব ‘তোমার মোহন রূপে রয় কে ভুলে।’ বা বর্ষার সেই অপূর্ব রূপ: ‘তিমির অবগুণ্ঠনে বদন তব ঢাকি...’। এবার হয়তো চতুর পাঠক বুঝেছেন আমি বোধ হয় জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলছি। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। এর অভিঘাত আমাদের সামনের প্রজন্মের জন্য অতি কষ্টদায়ক হতে পারে।

গত কয় বছরে আবহাওয়ার যে উল্টো-পাল্টা আচরণ আমরা দেখছি, অন্যদের মধ্যে তার দুটি অভিঘাত হতে পারে। প্রথমটা অবশ্যই আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির রূপ। রবীন্দ্রনাথের যে ঋতুভিত্তিক গান আমরা গাই, তার অনেকটা তো আমরা যারা শহরে থাকি, তারা ভুলতে বসেছি। ঝিল্লিমুখর সাঁঝের কথা, এমনকি আমরা যারা গ্রামেই বড় হয়েছি, তাদের কজনেরই বা মনে আছে। তবে যেখানেই থাকি না কেন, বর্ষার আগের রূপ কী আছে?

‘আঁধার অম্বরে প্রচণ্ড ডম্বরু বাজিল গম্ভীর গরজনে’ কি আর তেমন শুনতে পাই। এ কি ক্রমেই বিলীন হবে? আমাদের দু-তিন প্রজন্ম পরে যারা আসবে, তারা কি রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে ‘মন্দ্রিল ডম্বরু গুরুগুরু’ আদৌ বুঝতে পারবে?

আমার মনে পড়ে কয়েক বছর আগে আমি যখন আন্তর্জাতিক কমিশন অন সাসটেইনেবল অ্যাগ্রিকালচার আনডার ক্লাইমেট চেঞ্জের উপ-সভাপতি ছিলাম তখন কমিশনের এক সভায় আমি বলেছিলাম, বাঙালি সংস্কৃতির একটা বড় অংশ বর্ষা-বন্দনা । সেটাই হয়তো হারিয়ে যাবে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে। না, আমি জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো খটমটে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে বসিনি। তার স্থান এটা নয়। কিন্তু এই সংস্কৃতি অপঘাত ছাড়াও আরেকটি ব্যাপার ঘটতে পারে এবং তার আলামত গত বছরে আমার মতো অর্ধজ্ঞানসম্পন্ন লোকের চোখেও ধরা পড়েছে। এটাও সংস্কৃতি অপঘাতের মতোই অনেক বড় অপঘাত হতে পারে।

আমার বাড়ির ছাদে টবে একটা শেফালি ফুলের গাছ আছে। শেফালি ফুল ফোটার সময় আমরা এত দিন জেনে এসেছি শরৎ-হেমন্ত। গত কয়েক বছর আমার টবে তা ফুটছে ঠা ঠা গরমের মধ্যে মে-জুন মাসে। ঢাকায়ও এবার বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল হেমন্তে ফুটতে দেখা যাচ্ছে। আমরা জানি এ বছর জাপানে অসময়ে চেরি ফুল ফুটেছে। তাই নিয়ে জাপানি বৈজ্ঞানিকেরা বের করার চেষ্টা করছেন আবহাওয়ার ঠিক কোন বিরূপ কারণে তা ঘটছে। আমাদের বিজ্ঞানীরা কি বের করার চেষ্টা করছেন, কেন শেফালি আর কদম অসময়ে ফুটছে? তাঁরা কি এ নিয়ে গবেষণা করছেন? তাঁরা কি জানার চেষ্টা করছেন হেমন্তলক্ষ্মী আর সোনার ধান উপহার দেবে কি না? যদি ক্রমাগত তার ব্যত্যয় হয়, তবে দেশ কি আবার ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রামে হার মানবে, নাকি কী ঘটছে তা বোঝার এবং বিজ্ঞানসম্মত সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করব? মন আর শরীর দুইয়ের খিদেই তো মেটাতে হবে।

এম আসাদুজ্জমান: বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা মহাপরিচালক।