ডেটলাইন তোপখানা রোড

পৌনে দুই শ বছর আগে ঢাকার তোপখানা-পল্টন ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনানিবাস; ঔপনিবেশিক শক্তির বড় ভরসাস্থল। নাম না পাল্টালেও স্বাধীন বাংলা এলাকাটির চরিত্র অনেকখানি পাল্টে নিয়েছে। স্বল্পায়তনের এই এলাকাতেই বহুকাল ধরে আমূল রূপান্তরবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর অফিস। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এসব ‘পার্টির’ পরিসরেই শত শত পরিবর্তনবাদী তরুণ-তরুণীর বিচরণ, বেড়ে ওঠা।

সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, তাতে তোপখানা-পল্টনের বামপন্থীরা অন্যতম স্থিরচিত্ত শক্তি। তবে এ ধরনের সংগঠনগুলো বহু ধারা ও জোটে বিভক্ত। এখনো অন্তত তিনটি জোটে কাজ করছে প্রায় ২১টি দল।

এত বিভক্তির মধ্যেও জাতীয় সম্পদ রক্ষা থেকে শুরু করে গুম-খুন-নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনে এমন প্রতিটি দলের ধারাবাহিক সক্রিয়তা আছে। সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশের জন্যও বাম দলগুলোর রয়েছে বহু দাবিদাওয়া। কিন্তু নির্বাচন আসতেই বাম কর্মীরা পড়েছেন রূঢ় বাস্তবতায়। নেতৃত্বের নির্বাচনী রণনীতিতে সন্তুষ্ট নন তৃণমূলের সংগঠকেরা। মুখে ‘নির্বাচন আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতা’ বললেও নতুন এই অধ্যায়ে উত্সাহমূলক কোনো অর্জন থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে কর্মীদের। এই পরিস্থিতির জন্য নেতৃত্বের দ্বিধাদ্বন্দ্ব-অদূরদর্শিতার প্রসঙ্গই আসছে আলাপচারিতায়।

এক জোট, তিন প্রতীক

এ দেশের বামপন্থীদের প্রধান সংঘ এখন বাম গণতান্ত্রিক জোট। এখানে মৈত্রীবদ্ধ আটটি দল। দশম বা নবম সংসদে এসব দলের কোনো জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। এসব দলের কেউ নিজেদের প্রতীকে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হননি এখনো। দলগুলোর কর্মীদের মধ্যে এই অতীত শূন্যতা পূরণের তীব্র আগ্রহ আছে। এবারের নির্বাচনে সে আকাঙ্ক্ষা কতটা মিটবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। যদিও জোটভুক্ত সবাই নির্বাচন করার লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবু সেই প্রস্তুতি যতটা ‘পরিস্থিতির দ্বারা বাধ্য হয়ে’, ততটা নয় সর্বাত্মক যুদ্ধরূপে।

নির্বাচন কমিশনে বাম জোটের মাত্র তিনটি দলের নিবন্ধন আছে। সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও খালেকুজ্জামান ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন বাসদ। এই তিন দল ছাড়া অন্য পাঁচটি দলের প্রার্থীদের নির্বাচন করতে হবে স্বতন্ত্র বা অন্য দলের প্রতীকে।

যত দূর জানা যায়, অনিবন্ধিত দলগুলোর অধিকাংশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির কোদাল প্রতীকে লড়বে। সিপিবি ও বাসদের প্রার্থীরা তাঁদের কাস্তে ও মই প্রতীকেই লড়তে চান। ফলে এক জোটভুক্ত হলেও বাম জোটের শতাধিক প্রার্থীকে লড়তে দেখা যাবে অন্তত তিনটি প্রতীকে। জোটভুক্ত গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি নির্বাচন করতে ইচ্ছুক স্বতন্ত্রভাবে। ২১ নভেম্বর রাতে আলাপকালে তিনি সে ইচ্ছার কথাই বললেন। অবশ্য তাঁর দলের কেউ কেউ প্রার্থী হবেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতীকে। সব মিলে বিচিত্র এক নির্বাচনী পরিস্থিতি বাম জোটে।

বাম-গণতান্ত্রিক জোট গড়ে উঠেছিল গত ১৮ জুলাই। এক বছরের আলাপ-আলোচনা-প্রস্তুতির ফল এই জোট। জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে কর্মীদের মধ্যে ছিল ব্যাপক উচ্ছ্বাস-উচ্চাশা। এত আগ্রহ, সম–আদর্শ এবং এক জোটভুক্ত হয়েও বহু প্রতীকে নির্বাচন করার ব্যাখ্যা হিসেবে শ্রমিকনেত্রী মোশরেফা মিশু ‘রণনৈতিক অনেক পার্থক্য’-এর কথা বললেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা সবাই একই প্রতীক নিলে ভালো হতো। কিন্তু আমরা কতখানি একই আদর্শের, সেই প্রশ্ন তো থেকেই যায়।’ এ বক্তব্য থেকে ইঙ্গিত মেলে, আদর্শ ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে জোটভুক্তরা এখনো পরস্পরের ব্যাপারে ‘আপসহীন’ বলেই তাঁদের বিবিধ প্রতীকে নির্বাচন করা। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী অপর দলের প্রতীকে নির্বাচন করার অর্থই ‘টেকনিক্যালি’ ভোটের যাবতীয় হিসাব-নিকাশ সেই দলের কোষাগারে জমা হবে। প্রতীকহীন দলগুলোতে এ নিয়ে আছে হতাশা।

বাম গণতান্ত্রিক জোট গঠনের পর থেকে গত পাঁচ মাসে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় অনেক কর্মসূচি নিয়েছে, বহু দাবিদাওয়া উত্থাপন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপ করেছে, নির্বাচন কমিশনেও বৈঠক করেছে। কিন্তু সরকার ও ইসি তাদের কোনো দাবিই পূরণ করেনি। তারপরও ‘নীতিগত প্রশ্নে আপসহীন’ এই দলগুলো নির্বাচনে যাচ্ছে কী ভরসায়? এ প্রশ্ন করতেই জোটের প্রথম সমন্বয়ক সাইফুল হক সরাসরি স্বীকার করলেন, ‘পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে নির্বাচনে যাচ্ছি।’ বাসদের (মার্ক্সবাদী) নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তীও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করে বললেন, ‘আমরা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের আন্দোলনে সফল হইনি, ব্যর্থই হয়েছি।’

অর্থাৎ সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ অর্জনের আন্দোলনে ব্যর্থতার পরও তারা ওই ‘আন্দোলনের অংশ’ হিসেবেই এই জোট নির্বাচন করছে। কিন্তু আলাপচারিতায় মনে হয়নি জোটের কর্মীরা এ রকম ব্যাখ্যায় উদ্বুদ্ধ।

নির্বাচনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেই

বাম জোটের গত পাঁচ মাসের সভাগুলোতে নজর রেখে কখনোই মনে হয়নি, তারা পূর্ণশক্তিতে রাজপথে নামছে। শক্তি-সামর্থ্যে জোটভুক্ত বড় দু-তিনটি দল কর্মসূচিগুলোতে অংশ নিয়েছে নামকাওয়াস্তে। জাতীয় পর্যায়ের বড় দুই জোট থেকে নিজেদের দূরে রাখতেই এসব দলের নেতৃত্ব নিজেদের তৎপরতার সফলতা দেখছেন। ‘সমদূরত্বের তত্ত্ব’ নাম দেওয়া হয়েছে একে। নিজেদের ‘শ্রেণি-রাজনীতি’র স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে বাম জোট ঐক্যফ্রন্টের মতো মধ্যপন্থীদের সঙ্গে সংলাপেও আপত্তি দেখিয়েছে। এতে পরোক্ষভাবে সরকারই লাভবান হয়েছে। আর দুর্বল হয়েছে সামগ্রিক নির্বাচনী সংস্কার আন্দোলন। এরূপ আন্দোলন বহুধাবিভক্ত থাকায় ইসি তা নির্বিঘ্নে অগ্রাহ্য করতে পেরেছে।

অতীতে ড. কামাল হোসেন কিংবা মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে বাম নেতৃত্বের রাজনৈতিক নৈকট্য থাকলেও এবার হঠাৎই তাঁদের সঙ্গে সংলাপেও তাঁদের অনীহা ছিল। যাঁরা এমন সংলাপের প্রশ্নে ইতিবাচক ছিলেন, জোটের বৈঠকে তাঁরা ‘সমদূরত্ব তত্ত্ব’ই মেনে নিয়েছেন। কামাল হোসেন, মান্না ছাড়াও আমীর খসরু ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ব্যাপক আগ্রহ সত্ত্বেও নিজেদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া নিয়ে বামেরা অপর বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে অঙ্গীকার ও বোঝাপড়ার সম্ভাবনা কাজে লাগানো প্রয়োজনীয় মনে করেনি। তাতে নির্বাচনী সমঝোতা থেকেছে আরও দূরের বিষয় হয়ে; অর্থাৎ আন্দোলনের মতোই নির্বাচন করাকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে জোটে আগ্রহের সচেতন ঘাটতি ছিল।

এর আরেক বড় প্রমাণ, জোটভুক্ত আটটি দলের অন্তত সাতটির কোনো মুখ্য নেতাই নির্বাচন করছেন না। ‘নির্বাচনকে আন্দোলনের অংশ’ বললেও এসব দলের প্রধান নেতারা শুধু মাঠপর্যায়ে নবীন সংগঠকদেরই সেই আন্দোলনে নামাতে চাইছেন। ‘আপনারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচন করছেন না কেন?’—জোটভুক্ত শ্রমিকনেত্রী মোশরেফা মিশুকে এই প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, ‘এটা অপ্রিয় প্রশ্ন। আপাতত শুধু এটুকুই বলা যায়, নির্বাচন কোনো ধরনের উৎসবমুখর পরিবেশে হচ্ছে না।’

বাস্তবে তোপখানা রোডে কান পাতলে অনানুষ্ঠানিকভাবে বোঝা যায়, বাম জোট নেতৃত্ব ‘ইমেজ’ নষ্ট করতে চাইছে না। জোটের অন্যতম নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী অবশ্য এটা মানতে নারাজ। তাঁর ভাষায়, ‘এটা জোটভুক্ত দলগুলোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই হচ্ছে। আঞ্চলিক সংগঠকদেরই নির্বাচন করতে বলা হচ্ছে।’ তাঁর দলের প্রায় ২০ জন ‘আঞ্চলিক নেতা’কেও নির্বাচন করতে হচ্ছে। যদিও দলের প্রধান দুই নেতা—তিনি ও মুবিনুল হায়দার চৌধুরী নির্বাচন করছেন না। সিপিবিতে প্রেসিডিয়ামের চার সাহসী তরুণ সংগঠকের বাইরে প্রধান নেতারা (মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, শাহ আলম প্রমুখ) কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন না। বাসদের নেতা খালেকুজ্জামানও প্রার্থী হচ্ছেন না। ব্যতিক্রম শুধু গণসংহতির জোনায়েদ সাকি। স্বতন্ত্র কিংবা অন্যদের প্রতীক যা–ই হোক না কেন, তিনি ভোটযুদ্ধ থেকে পালাতে অনিচ্ছুক। আরেক ব্যতিক্রম সিপিবির মনজুরুল আহসান খান। তিনি ৭৪ বছর বয়সেও জামালপুরের ইসলামপুরে উঠানে উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু এ রকম দু–একজন ‘নির্বাচনী আন্দোলন’-এ জোটের অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেননি, এটাই সত্য।

তবে বামদের চলতি নির্বাচনী টানাপোড়েন ঐতিহাসিক বিচারে একেবারে আকস্মিক নয়। অতীতেও নির্বাচন এলে তাতে অংশ নেওয়ার প্রশ্নে বাম শিবিরে বিতর্ক-বিসংবাদ লেগে যেত। যদিও কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে দ্বিতীয় অধ্যায়ে মার্ক্স-অ্যাঙ্গেলসের নির্দেশনা ছিল স্পষ্ট, ‘শ্রমিকশ্রেণিকে গণতন্ত্রের সংগ্রামেও জিততে হবে। এটাই তার সংগ্রামের প্রথম ধাপ।’

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক