পাঁচ বাঙালি হত্যার পেছনে কে?

ভারতের আসাম রাজ্যে পাঁচ বাঙালি খুনের পর ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেল, কিন্তু পুলিশ ও গোয়েন্দারা এ বিষয়ে রহস্যের জট খুলতে পারেনি। খুনের উদ্দেশ্য অবশ্য পরিষ্কার: আসামে বাঙালিদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করা। কিন্তু কারা চাইছে বাঙালিদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে? আসামের রাজনীতিতে এখন এটাই বড় প্রশ্ন।

১ নভেম্বর আসামের তিনসুকিয়া জেলায় পাঁচ নিরীহ বাঙালিকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর থেকে আসামে বসবাসরত বাঙালিরা ভয়ংকর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। আসামের বাঙালিদের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করে, গোয়েন্দারা অন্ধকারে নেই। পুলিশ ইচ্ছে করেই চোখ বুজে আছে। আর সেই সন্দেহেই পোক্ত হচ্ছে রহস্যের গন্ধ। প্রথম থেকেই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (ইনডিপেনডেন্ট) তথা উলফাকে (আই) পুলিশ দায়ী করে চলেছে। উলফা-আই ঘটনার দায় অস্বীকার করলেও পুলিশ-কর্তারা একই ঢাক পিটিয়ে চলেছেন। এক সন্দেহভাজনকে আটক করলেও হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের কোনো খবর নেই। শুধু তল্লাশি অভিযানের কথা ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। খুনের উদ্দেশ্য নিয়েও গোয়েন্দারা কোনো কথা বলছেন না।

এনআরসি (নাগরিক পঞ্জি) আর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে এমনিতেই বাঙালিদের ভোগান্তির শেষ নেই। বারবার তাদের নিজেদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হচ্ছে। কয়েক পুরুষ ধরে বংশপরম্পরায় ভারতে বসবাস করেও লাভ হচ্ছে না। সন্দেহ ‘বাংলাদেশি’। অসমিয়া জাত্যভিমান কয়েক যুগ ধরে বাঙালিদেরই চাঁদমারি করে চলেছে।

কী হয়েছিল সেদিন? ১ নভেম্বর গ্রামের একটি দোকানে বসে নিজেদের মধ্যে সান্ধ্য আড্ডায় মশগুল ছিলেন ছয়জন বাঙালি মৎস্যজীবী। সেখান থেকে একদল বন্দুকবাজ তাঁদের তুলে নিয়ে যায়। একজন রাতের অন্ধকারে পালিয়ে প্রাণে বাঁচলেও বাকি পাঁচ  বাঙালিকেই লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে সশস্ত্র দলটি। প্রাণ নিয়ে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসা সহদেব শুক্ল বৈদ্যকে এখন দফায় দফায় বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা জেরা করে চলেছে। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের সূত্র ধরে এখনো কোনো সাফল্যের আভাস দেখতে পায়নি পুলিশ। তিনি বিস্তারিতভাবে জানিয়েছেন ঘটনার বিবরণ। পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি সাংবাদিকদের সামনেও স্পষ্ট বর্ণনা দিচ্ছেন সেই ভয়ংকর রাতের। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দুটি দলে ভাগ হয়ে ফৌজি পোশাক পরা আগন্তুকেরা ঠান্ডা মাথায় গুলি করে অন্ধকারে গা ঢাকা দেয়।

আসামের এ অঞ্চল বহুকাল ধরে বাঙালি আর নেপালিদের বাসভূমি। জঙ্গিদের করিডর বলে পরিচিত এই গ্রামে অসমের সাধারণ মানুষও নিশ্চিত, উলফা-আই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। পরেশ বড়ুয়ার দলের বিবৃতিই তাঁরা বিশ্বাস করেন। কারণ, উলফা গণহত্যা চালালে তার দায় স্বীকার করে। এটাই দস্তুর। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারা অস্বীকার করেছে। উলফার নেতা অনুপ চেটিয়াও প্রথম আলোকে এ কথাই বলেছেন। তিনি নিশ্চিত এ হত্যাকাণ্ড উলফা চালায়নি। অনুপের অভিযোগ, বিজেপির মস্তিষ্ক বলে পরিচিত হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘই এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। তিনি বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেবকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।

অনেকেই কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজ্য রাজনীতিকেই দায়ী করছেন। এনআরসি আর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে বর্তমানে আসামের রাজ্য রাজনীতি উত্তাল। অসমিয়া আধিপত্যবাদীদের কড়া মনোভাবে দিশেহারা শাসক দল বিজেপি। আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে তাদের জোট শরিক অসম গণপরিষদ (অগপ) আলাদা লড়ছে। এমনকি, মন্ত্রিত্ব ছাড়ার হুমকিও দিয়ে রেখেছে দলটি। অন্যান্য অসমিয়া সংগঠনও ক্ষুব্ধ বিজেপির ওপর।

রাজ্যের বিরোধী দলের নেতা দেবব্রত শইকিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনসুকিয়া হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত তদন্ত করতে হবে। ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে রাজ্য সরকার ব্যর্থ।’ সেই সঙ্গে বিরোধী দলনেতার মতে পাঁচ বাঙালি খুনের ঘটনা অবশ্যই খুব রহস্যজনক। এর জন্য তিনি বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের মন্তব্যও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ঘটনার পর এতগুলো দিন কেটে গেলেও মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল এখনো ‘অন্ধকারে’ বলে কটাক্ষ করেন তিনি। প্রশ্ন তোলেন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সক্ষমতা ও আন্তরিকতা নিয়ে। দাবি করেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী এনআইএকে দিয়ে তদন্তের।

জাতীয় মুক্তিবাহিনী, বাঙালির (এনএলএফবি) স্বঘোষিত কমান্ডার-ইন-চিফ কৃষ্ণ পোদ্দারও প্রথম আলোকে বলেছেন তাঁদের বিশ্বাসের কথা। তিনি বলেন, ‘উলফা করেনি। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড কারা করেছে, সেটা খুঁজে বের করার বিষয়ে সরকার ব্যর্থ। আমরা চাই এনআইএ তদন্ত।’ তদন্তের বিষয়ে আসাম বা ভারত সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। দাবি করেন, প্ররোচনামূলক বক্তব্য দিয়ে যেসব অসমিয়া নেতা উত্তেজনা তৈরি করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের। রাজ্য সরকার অবশ্য প্ররোচনামূলক বিবৃতির অভিযোগে দু-একজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। পরে অবশ্য তাঁরা ছাড়াও পেয়ে যান।

তাই আসাম রাজ্য নাগরিক অধিকার রক্ষা সমন্বয় সমিতির সভাপতি তপোধীর ভট্টাচার্যের সাফ কথা, ‘উলফা বা অন্য কেউ এই খুন করেনি। খুন করেছে রাষ্ট্র। কারণ, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী অসম ও ভারত সরকারের বাঙালি বিদ্বেষী নীতি।’ আরও এক ধাপ এগিয়ে তাঁর প্রশ্ন, ‘আর কত বলি চায় জাতিবিদ্বেষী ঘাতক রাষ্ট্র?’ শুধু মুখে নয়, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাবেক উপাচার্য রীতিমতো সামাজিক গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন, ‘ঘাতক রাষ্ট্র’।

তপোধীর যা-ই বলুন না কেন, খুনি কে—এই প্রশ্ন এখন আসামের বাঙালিদের ঘরে ঘরে। কারণ, অচেনা ঘাতক রাজ্যটিতে আরও বড় বিপদ ডেকে আনার আশঙ্কা জিইয়ে রেখেছে। বহু মানুষ রক্ত দিয়েছে শুধু জাতিবিদ্বেষের কারণে। আজও চলছে সেই রক্তস্রোত। এমনকি রাষ্ট্রও ছিনিয়ে নিয়েছে বহু প্রাণ। আসামের বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে ১৯৬১ সালের ১৯ মে প্রাণ হারান ২১ জন বাঙালি ভাষাসৈনিক। এ রকম অজস্র ঘটনার স্মৃতি আজ আতঙ্ক নিয়ে আসছে আসামবাসী ভারতীয়দের মনে।

রাজনীতির কারবারিরা অবশ্য এখন অনেক প্রশ্নই ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত। সামনেই গ্রাম দখলের লড়াই। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন। তারপর আবার লোকসভা ভোট। উগ্র অসমিয়া জাত্যভিমান আর রাজনীতির ‘পাটিগণিত’ পাঁচ বাঙালির রক্তে ভেজা মাটিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ভোটের অঙ্ক কষতে। অজানাই থেকে যাচ্ছে পাঁচ বাঙালির রক্ত ঝরার কারণ। ফিকে হয়ে আসছে এনআইএ, বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রভৃতি দাবি; বরং বাড়ছে এনআরসি বা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে বাঙালিবিদ্বেষ। সেই সঙ্গে  বাড়ছে বাঙালিকে দুর্বল করতে ধর্মীয় সুড়সুড়ির অপব্যবহারও। ফলে আসামের বাঙালিদের মনে দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে।

তরুণ চক্রবর্তী প্রথম আলোর ত্রিপুরা প্রতিনিধি