বিএনপি দেশ বদলাতে চায়, প্রার্থী নয়

গত বছর বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে যখন বিএনপি রূপকল্প ২০৩০ ঘোষণা করেছিল, তখন বলা হয়েছিল, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনাই তাদের উদ্দেশ্য। গুণগত পরিবর্তন মানে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানোন্নয়ন, সব ধরনের বিতর্ক ও কালিমা থেকে দলকে মুক্ত রাখা। কিন্তু আমাদের রাজনীতির প্রধান কুশীলব, সেটি হোক আওয়ামী লীগ বা বিএনপির—তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, ওই দলের মাস্তান ঠেকাতে আমাদের দলেও মাস্তানের প্রয়োজন আছে, ওই দলে দুর্নীতিবাজ থাকলে আমাদের দলেও দুর্নীতিবাজদের জায়গা দিতে হবে। এভাবেই রাজনীতি এখন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এবারের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা জাতীয়তাবাদী প্রেরণা দুটোই ঢের পেছনে পড়ে গেছে।

বিএনপির নেতারা রাজনৈতিক সংস্কারের অনেক বড় বড় কথা বলেছিলেন, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা খর্ব করে রাষ্ট্রপতির হাতেও কিছু ক্ষমতা রাখার অঙ্গীকার করেছিলেন। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাজনীতিতে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি তথা বুদ্ধিজীবীদের জ্ঞান-মেধাকে কাজে লাগানোর কথা বলেছিলেন। বিএনপির নেতারা এ–ও বলার চেষ্টা করেছিলেন যে তাঁরা ক্ষমতায় এলে প্রতিহিংসার রাজনীতিকে চিরতরে বিদায় জানানো হবে। সমঝোতার ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করবেন। ক্ষমতার বাইরে থাকলে সব দলই এ ধরনের সাধু ও মিষ্টি কথা বলে জনগণের মন ভোলাতে চায়। কিন্তু ক্ষমতায় গেলেই আমরা তাদের ভিন্ন চেহারায় আবির্ভূত হতে দেখি।

বিএনপির সেই ঘোষণার পর বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে এখন কারাগারে; যদিও বিএনপির দাবি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই তাঁকে জেলে রাখা হয়েছে। হাইকোর্টের সর্বশেষ রায়ে বলা হয়েছে, দুই বছরের বেশি শাস্তি হয়েছে—এমন কোনো দণ্ডিত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, যদি আপিল বিভাগ শাস্তি স্থগিত না করেন। নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে শাস্তি স্থগিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ তাঁর নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি অনেকটাই অনিশ্চিত। এখন বিএনপির নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিই প্রধান নির্বাচনী অ্যাজেন্ডায় পরিণত করেন কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বিএনপির শুভানুধ্যায়ীদের দাবি, ১২ বছর ধরে দল ক্ষমতার বাইরে থাকায় দলীয় নেতা-কর্মীদের বড় শিক্ষা হয়েছে এবং অতীতে তাঁরা যেসব ভুল করেছেন, ভবিষ্যতে আর করবেন না। বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে জোট গঠন করায় এই শুভানুধ্যায়ীদের অনেকে আশাবাদী হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন বিএনপির বোধোদয় ঘটেছে, তারা হঠকারী লাইন থেকে সরে আসবে। প্রতিদিন টেলিভিশনে বিএনপির তরুণ তুর্কিরা যেভাবে সাচ্চা গণতন্ত্রের সবক দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে মনে হয়েছিল, এবারে সত্যি সত্যি বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেবেন।

কিন্তু বিএনপির মনোনয়ন তালিকা আমাদের খুবই হতাশ করেছে। ক্ষমতায় থাকতে যাঁরা নানা অপকর্ম করেছিলেন, যাঁরা জঙ্গিবাদে মদদ জুগিয়েছিলেন, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন, মনোনয়ন তালিকায় তাঁদের নামও আছে। তালিকায় আছেন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দণ্ডিত ব্যক্তির সন্তানও। আবার মামলা বা অন্য কোনো কারণে যাঁদের মনোনয়ন দেওয়া যায়নি, তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের মনোনয়ন দিয়ে ‘পুরস্কৃত’ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগেও এমনটি হয়েছে।

সোমবার বিকেল থেকে বিএনপির প্রার্থীদের মনোনয়নের চিঠি দেওয়া শুরু হয়ে চলে গতকাল রাত পর্যন্ত। মূলত ২০০১ সালের নির্বাচনকে ভিত্তি ধরে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। যেসব আসনে দলীয় মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়েছে, তাতে বেশির ভাগই পুরোনো মুখ। এর মধ্যে জোট সরকারের সময় বিতর্কিতদের অনেকে আছেন। মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্যে আছেন একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত আবদুল আলীমের ছেলে ফয়সাল আলীম। তিনি জয়পুরহাট-১ আসনের প্রার্থী। চট্টগ্রামে বিতর্কিত গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এক ছেলেও মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে শোনা গেছে। অন্যদিকে জামায়াত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলেও ধানের শীষে নির্বাচন করছেন। নিবন্ধন না থাকায় জামায়াত স্বনামে নির্বাচন করতে পারছে না, তাই দণ্ডপ্রাপ্ত মানবতাবিরোধী অপরাধীর সন্তানের ভরসা হিসেবে থাকছে ধানের শীষই।

চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২০০৪ সালে বিএনপির মন্ত্রী আমিনুল হক, উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সাংসদ নাদিম মোস্তফা জেএমবির নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে নানাভাবে মদদ দিয়ে দলের ভেতরে–বাইরে সমালোচিত হয়েছিলেন। ২০০৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে রাজশাহী অঞ্চলের বাগমারা, রানীনগর ও আত্রাই উপজেলায় বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জঙ্গিরা ‘সর্বহারা’ দমনের নামে হত্যা-নির্যাতনসহ অরাজকতা কায়েম করে। ২০০৬ সালের মার্চে গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাংলা ভাই টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে যে জবানবন্দি দেন, তাতে আমিনুল হক, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার ও নাদিম মোস্তফার সহযোগিতা পাওয়ার কথা বলেছিলেন। সে সময়ে বিএনপির আরেক সাংসদ আবু হেনা প্রকাশ্যে মন্ত্রী আমিনুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। এবারে অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত সবাই মনোনয়ন পেয়েছেন। অন্যদিকে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শে দীক্ষিত’ আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ গোলাম মাওলা রনি সোমবার বিএনপিতে যোগ দিয়েই দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। এই হচ্ছে আদর্শের রাজনীতির দশা। তিনি পটুয়াখালী-৩ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

জোট সরকারের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আলতাফ হোসেন চৌধুরী। তাঁর সময়েই সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন হয়। পত্রপত্রিকায় সেসব খবর ছাপা হলে তিনি বলেছিলেন, পত্রিকাগুলো অতিরঞ্জন করছে। সন্ত্রাসীর গুলিতে বাবার কোলে থাকা সন্তান নিহত হওয়ার পর এই মন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়েছেন।’ এ নিয়ে তখন সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। পরে তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করে প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামানের হাতেই পুরো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভার ন্যস্ত করা হয়। তাঁর সময়েই ঘটে ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ অনেক বোমা হামলার ঘটনা। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রাণ হারিয়েছিল দলটির ২২ জন নেতা-কর্মী। অথচ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বাবর বিরোধী দলের ওপর দায় চাপিয়েছিলেন। এখন সেই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীও মনোনয়ন পেয়েছেন। তালিকায় আছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী বাবরের স্ত্রীর নামও। আরও বেশ কয়েকজন বিতর্কিত সাবেক সাংসদ ও মন্ত্রী মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, পিতার অপরাধের দায় কেন পুত্ররা নেবেন? পুত্ররা দায় নেবেন না ঠিকই। কিন্তু পুত্ররা যে নিজেদের যোগ্যতার চেয়ে পিতাদের কারণেই মনোনয়ন পেয়েছেন, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। যুদ্ধাপরাধীর দোসর ও রাজাকার তোষণকারী হিসেবে বিএনপির যে ভাবমূর্তি শুরু থেকেই তৈরি হয়েছিল, তা দূর করার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল এবারের নির্বাচনে। কিন্তু তা কাজে লাগানোর সুযোগ নিল না বিএনপি।

বিএনপি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে চায় বলে দাবি করে। দেশের রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন ও শুদ্ধ করার কথা বলে। কিন্তু যেসব নেতা সেই পরিচ্ছন্ন ও শুদ্ধ রাজনীতির অন্তরায়, তাঁদেরই মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। এঁদের নিয়েই দিনবদল করবে বিএনপি? এসব বিতর্কিত ব্যক্তিকে নিয়ে রাজনীতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলা সোনার পাথরবাটি ছাড়া কিছু নয়।
প্রার্থী বদলের সাহস না থাকলে কি রাজনীতি ও দেশ বদলানো সম্ভব?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail. com