মাশরাফি ঠিক করলেন?

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম নেওয়ার পর বিজয় সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখান মাশরাফি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম নেওয়ার পর বিজয় সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখান মাশরাফি। প্রথম আলো ফাইল ছবি

রাজনীতিতে নানা ধরনের চমক থাকে। এবারের জাতীয় নির্বাচনও চমকে ভরপুর। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ঘটনা চমক হয়ে আসছে। এখনো পর্যন্ত অন্যতম বড় চমক হচ্ছে জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার রাজনীতিতে আগমন। তিনি নড়াইল-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, এটা কোন অর্থে চমক। কারণ, বেশ কিছুদিন ধরেই তাঁর রাজনীতিতে আসার খবর বিভিন্ন মুখে শোনা যাচ্ছিল। মাশরাফি কিন্তু নিজে খোলাসা করে কিছুই বলেননি। ভক্তদের অপেক্ষায় রেখেছেন। ধুম করে মনোনয়নপত্র কিনে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। তিনি এখনো জাতীয় ক্রিকেট ওয়ানডে দলের অধিনায়ক। শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্য কোনো দেশে জনপ্রিয় কোনো অধিনায়ক দায়িত্বরত অবস্থায় নির্বাচন করেছেন বলে জানা নেই। এ রকম ঘটনা থাকলেও থাকতে পারে।

যা–ই হোক, মাশরাফি রাজনীতি করতেই পারেন। এটা তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার। মাশরাফির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো উচিত। তাঁর মতো সচেতন লোকদের রাজনীতিতে খুবই দরকার। তাঁর এই সিদ্ধান্ত আরও অনেককেই উৎসাহিত করবে। মাশরাফি যেভাবে দক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে সামলেছেন, সেভাবেই তিনি রাজনীতিকে সামলাবেন বলে আশা করি।

একটি কথা হরহামেশাই শুনতে পাই, রাজনীতি ভালো মানুষ করে না। রাজনীতি পচে গেছে। মেধাবীদের জন্য রাজনীতি না। এসব কথা ঠিক নয়। রাজনীতিতে সবার আসা উচিত। যোগ্য, সৎ, মেধাবীরা টিকে থাকবেন। অন্যরা ঝরে যাবেন—এটাই স্বাভাবিক। আমাদের রাজনীতি এখন দুর্বৃত্তদের দখলে। এদের দখলদারি থেকে থেকে দেশ ও রাজনীতিকে বাঁচাতে হলে মাশরাফিদের প্রয়োজন। মাশরাফির রাজনীতিতে আগমনকে তাঁর বিরোধী পক্ষেরও স্বাগত জানানো উচিত। রাজনীতিকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হলে স্বচ্ছ ইমেজের জনগণের অধিক সম্পৃক্ততা দরকার। কিন্তু সেটা সঠিকভাবে। নীতি-নৈতিকতাকে পেছনে ফেলে নয়। এখানেই প্রশ্ন।

মাশরাফি তাঁর ফেসবুক পেজে রাজনীতিতে আসার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, দুটি ভালো বল করে বা মানুষকে জড়িয়ে ধরে ভালো মানুষ হওয়ার ইচ্ছা কোনোকালেই ছিল না। এটা মাশরাফির সীমিত অনুধাবনক্ষমতার পরিচায়ক। মাশরাফি জানেন না যে তাঁর ‘দুটি ভালো বল’ দেশকে ও তাঁকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যায় বিশ্ব ক্রিকেট দরবারে।

মাশরাফি বলেছেন, রাজনীতি না করে দেশে উন্নয়ন জোরালোভাবে কিছু করা সম্ভব নয়। এ কথার মাধ্যমে চেতনে-অবচেতনে তিনি অন্য পেশাজীবীদের অবদানকে খাটো করেছেন। অন্যভাবে, রাজনীতি না করে দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত হওয়া যাবে না—এটা যথার্থ ধারণা নয়। ১৬ কোটি মানুষের সবাই রাজনীতিতে না নেমেও দেশের উন্নয়নে নানাভাবে ভূমিকা রাখছেন। বিদেশ থেকে লাখ লাখ প্রবাসী মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স পাঠান, পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা রাত-দিন পরিশ্রম করে বৈদেশিক অর্থ উপার্জনে ভূমিকা রাখছেন—এঁদের কি দেশের উন্নয়নে ভূমিকা নেই?

মাশরাফি মানসিক দেয়াল ভাঙার কথা বলেছেন। আরও অনেক দেয়াল ভাঙার কাজও শুরু করতে হবে। যেকোনো দুর্নীতিবাজ, ব্যাংক লুটেরা, হাজার কোটি টাকা পাচারকারী, বাংলাদেশ ব্যাংকে সোনাকে তামা বানিয়ে ফেলা, গডফাদার ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতে হবে। নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে তিনি এসবের বিরুদ্ধে তাঁর নিজের অবস্থান পরিষ্কার করবেন আশা করি। মাশরাফিকে হাতুড়ি বাহিনী, চাপাতি বাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। আগুন-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, হেলমেট বাহিনীর বিরুদ্ধে মাঠে নামতে হবে। গুম, অপহরণ বন্ধের জন্য পথে নামতে হবে। মাশরাফি ভ্রাতৃত্ববোধে সহনশীল ও সহযোগিতাপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁকে তো নিজেরই অসম প্রতিযোগিতার সুবিধা নিতে হতে পারে। তিনি যেখানে নির্বিঘ্নে প্রচারের সুযোগ পাবেন, সেখানে তাঁর বিপক্ষের লোকজন হয়তো দাঁড়াতেই পারবেন না। এসব নিয়ে মাশরাফি কিছু বলেছেন বলে দেখিনি। এসব বিষয়ে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার হওয়া দরকার।

মাশরাফি গতানুগতিক কিছু উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের কথা বলেছেন। এই প্রথাগত উন্নয়নের ধারণা থেকে তাঁকে বের হয়ে আসতে হবে। বরং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে কেন উন্নয়ন হচ্ছে না, তা খুঁজে বের করতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলে বাহবা নেওয়ার দিন আর নেই, বরং নির্বাচিত হলে এটাই হবে তাঁর দায়িত্ব। তিনি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কোনো কথা বলেননি। তাঁকে সবার স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা নিয়ে কথা বলতে হবে। বাক্‌স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে হবে। যশোরের আবু বক্করের হত্যাকাণ্ড কি মাশরাফিকে স্পর্শ করে? আবু বক্করও তাঁর মতোই মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তবে ভিন্ন দল থেকে বা একরামের মেয়ের বলা সেই কথা কি মাশরাফির মনে আছে—আব্বু, তুমি কান্না করতেছ যে? তিনি কি নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যা নিয়ে কিছু বলবেন। কারণ, এই আবু বক্কর, একরামের মেয়ে বা ত্বকীরাও যে তাঁর ভক্ত।

মাশরাফি ২০১৯ সালে বিশ্বকাপ খেলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। জাতীয় দলে তাঁর উপস্থিতি আমাদের সাহস দেয়। তাঁকে অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু একই সঙ্গে অধিনায়কত্বের পদ ও নির্বাচনী প্রচার; ঠিক যায় না। এখানে আইনগত কোনো বাধা নেই। তবে মনে রাখতে হবে, মাশরাফি বিসিবির বেতনভুক্ত খেলোয়াড়। আর বিসিবি বাংলাদেশ নামক প্রজাতন্ত্রের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রজাতন্ত্রের একটি প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক্ত হয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে নির্বাচন করা কতটা নৈতিক? অনেকেই বলতে পারেন, বিসিবি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের অর্থ সরাসরি জনগণের পকেট থেকে আসে না। কিন্তু বিসিবি বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান। মাশরাফি যে জার্সি গায়ে চাপিয়ে বল করার জন্য ২২ গজের পিচের দিকে দৌড়ে যান বা যে পতাকার প্রতিনিধিত্ব করেন, এসবের মালিক কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ। এটাও মাশরাফিকে ভাবতে হবে। মাশরাফির উচিত জাতীয় দল থেকে পদত্যাগ করা। না হলে এটা বাজে উদাহরণ হয়ে থাকবে। সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয় বা আরিফ খান জয় নির্বাচন করেছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর জয় ব্যক্তিগত পিস্তল নিয়ে মাঠে প্রবেশ করেছেন। এসব নিয়ে কারও মনে কোনো ভাবান্তর হয়নি। কারণ, ওনারা খেলা থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে এসেছেন। দুজনই সাবেক সংসদ সদস্যের ছেলে। অনেকেই জানতেন, তাঁরা রাজনীতিতে আসতে পারেন। আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করেছেন। সালাম মুর্শেদী উপনির্বাচনে জিতেছেন। এখনো চুন্নু, মুর্শেদী, দুর্জয়, জয় দলমত-নির্বিশেষে সবার প্রিয় খেলোয়াড়। কারণ, খেলা ও রাজনীতিকে তাঁরা গুলিয়ে ফেলেননি।

মাশরাফি যদি রাজনীতি ও খেলা একই সঙ্গে চালিয়ে যান, তবে তা ভালো নজির হয়ে থাকবে না। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থেকে অনেকেই রাজনীতিতে আসার সুযোগ খুঁজবে। রাষ্ট্রীয় অনেক কাঠামোর মধ্যে এটা ঢুকে গেছে। কিন্তু খেলাতেও যদি এসব ঢুকে পড়ে, তা হবে দুঃখজনক।

মাশরাফি ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে আছেন। এবার নির্বাচনে অংশ না নিলে তাঁকে আরও চার-পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হতো। তিনি মনে হয় অপেক্ষা করতে চাননি। তাই খেলা শেষ করার আগেই রাজনীতিতে চলে এলেন। আবার বিশ্বকাপে খেলার সুযোগও হারাতে চাইছেন না। খেলা না রাজনীতি—মাশরাফি যেকোনো একটি বেছে নিলেই পারতেন।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, মাশরাফিকে এত কিছু করতে হবে কেন? এর উত্তর মাশরাফি নিজেই দিয়েছেন। দেয়াল ভাঙতে হবে। ক্রিকেট খেলে মাশরাফি নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। মাশরাফি সবার নায়ক। তাই নায়কের কাছে প্রত্যাশাও বেশি। রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত মাশরাফি নিজেই নিয়েছেন। বাকি সিদ্ধান্তও নিজেকেই নিতে হবে। তিনি কি গণমানুষের নায়ক হিসেবেই থাকবেন, নাকি স্রোতে গা ভাসাবেন? মাশরাফির মতো সৎ, স্বচ্ছ ইমেজসম্পন্ন ব্যক্তির রাজনীতিতে আগমনে আমরা যেমন আশাবাদী, আবার হতাশও। আশাবাদের কথা শুরুতেই বলেছি। হতাশার কারণ শেষেই বলি। তার শুরুই হচ্ছে নীতি-আদর্শকে পেছনে ঠেলে দিয়ে। অনেক ভালোর উদাহরণ মাশরাফি বিন মুর্তজা শেষ পর্যন্ত একটি খারাপের উদাহরণ হয়ে যান; আমাদের নায়কের এমন পরিণতি আমরা চাই না।

ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন