আশাব্যঞ্জক নয় প্রার্থী তালিকা

জাতীয় সংসদে আসনসংখ্যা ৩০০+৫০। এর বাইরে দর্শকদের জন্য আছে আরও কিছু আসন। এখন তো টেলিভিশনের কল্যাণে সবাই দর্শক। কিন্তু সদস্যদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসার জন্য হুটোপুটি লেগে গেছে। যাঁরা সিরিয়াস, তাঁরা গাঁটের পয়সা খরচ করে সংসদে ঢোকার টিকিট পাওয়ার আশায় আরেকটি টিকিট কিনেছেন। তাঁদের সংখ্যা ছিল আট হাজারের বেশি। এখন দলগুলো আস্তে আস্তে টিকিট ছাড়তে শুরু করেছে।

প্রার্থীজট দেখে বড় দলগুলো ভয় পেয়েছিল। টিভি ক্যামেরার সামনে সবাই ভালো ভালো কথা বলেন। নেত্রী যাঁকেই মনোনয়ন দেন, আমরা তাঁকেই সহযোগিতা দেব। দলের নেতারা এতে আশ্বস্ত হননি। প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে ঘোষণা এসেছে, ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। এতে কতটুকু কাজ হবে, জানি না। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অন্তত ১৬ জন ‘বিদ্রোহী’ নির্বাচিত হয়েছিলেন। লালবাগের বিদ্রোহী প্রার্থী গণমাধ্যমে পরিষ্কার বলেছিলেন, ‘নেত্রী আমাকে “স্বতন্ত্র” হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন।’ তিনি এবারও দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। এর অর্থ হলো, জিতে আসতে পারলে সাতখুন মাপ। জেতাটাই মুখ্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দুটি ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ করে বলেছেন, উইনেবল ক্যান্ডিডেটরা মনোনয়ন পাবেন।

ভোটারের প্রার্থী বাছাইয়ের নিজস্ব মাপকাঠি আছে। দল হয়তো মনে করে, টাকা আর পেশির জোর থাকলে জেতা যায়। তারাই উইনেবল। আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকা দেখে মনে হলো, পুরোনো মুখের ছড়াছড়ি। নতুন মুখগুলোর অনেককেই পুরোনো পরিবার থেকে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ পরিবারতন্ত্রের শিকড় সব জায়গায় গেড়ে বসেছে। তারপর আছে জাতীয় পার্টি ও অন্য শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির প্রশ্ন। পুরোনো মুখগুলোই আসছে ঘুরেফিরে।

বিএনপি পড়েছে মহা মুশকিলে। দলের মধ্যে কার্যত ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। অর্থাৎ দলের দুই শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নির্বাচন করতে পারছেন না। আগেই এ দলের অনেক নেতা নানা মামলায় জড়িয়ে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় আছেন। দণ্ডিত নেতারা কেউ জামিনে আছেন, কেউবা আপিলের রায়ের অপেক্ষায় কাল গুনছেন। আদালত অবশ্য তাঁদের অনেকের আপিলই খারিজ করে দিচ্ছেন। দণ্ডাদেশ স্থগিত হচ্ছে না। সুতরাং অনেকেই ভোটের মাঠে থাকতে পারবেন না। সে জন্য বিএনপির মনোনয়ন তালিকায় অনেক আসনেই দু-তিনজন প্রার্থীর নাম দেখা যাচ্ছে। সেখানেও আছে প্রার্থীজট। তবে দলটি যেহেতু বেকায়দায় আছে, তাদের ‘বিদ্রোহী’রা কোন কৌশল নেবেন, এখনই তা বোঝা যাবে না। তারপর শরিকেরা তো আছেনই। প্রতিপক্ষের উচ্চাকাঙ্ক্ষী, বিক্ষুব্ধ ও বঞ্চিতরা এখন গণফোরামের ছাতার তলায় আশ্রয় নিয়ে সংসদে ঢোকার টিকিট খুঁজছেন। তাঁদের কীভাবে সামলানো হবে, তা এখন দেখার বিষয়।

নাগরিকেরা অনেক সময় অবাস্তব খোয়াব দেখেন। তাঁরা মনে করেন, সংসদে এবার ফেরেশতাতুল্য লোকের সংখ্যা বাড়বে। যাঁরা আস্তিন গুটিয়ে বা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে কথা বলেন, তাঁদের সংখ্যা কমবে, তরুণেরা আসবেন বেশি করে। মনোনয়ন তালিকা দেখে মনে হয়, নাগরিকদের আশা পূরণ হওয়ার নয়। আসলে নাগরিকেরা রাজনীতি বোঝেন না। বুঝলে তো সবাই রাজনীতি করতেন। সবারই এখন ইতালির রাজনীতিক-কূটনীতিক ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স বইটি পড়া দরকার।

আমাদের দেশে নির্বাচন এলেই ভজকট লাগে। পাঁচ বছর পরপর পথঘাট অশান্ত হয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদদের কথার লড়াইয়ে সাধারণ মানুষ জেরবার হয়। তারপর নামকাওয়াস্তে কিছু কথা চালাচালি হয়। আমরা এর নাম দিয়েছি ‘সংলাপ’, কিন্তু সংলাপটি চলে পুরোনো চিত্রনাট্য ধরেই। সংলাপের নিজস্ব একটি ওজন আছে, আছে ব্যঞ্জনা। এ দেশে শুরু থেকেই সংসদ কার্যকর হয়নি। একদিকে সরকারি দলের সবকিছু দখলের মানসিকতা, অন্যদিকে বিরোধী দলের লাগাতার সংসদ বর্জন। ফলে জাতীয় সংসদ কার্যকর হয়নি। অথচ সংসদই হচ্ছে সংলাপের জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা। নাগরিকদের প্রত্যাশা, আগামী সংসদটি হয়ে উঠুক আলোচনা আর বিতর্কের মাধ্যমে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিষ্পত্তির ফোরাম। কিন্তু ঝগড়াটে লোকজনে যদি সংসদ সয়লাব হয়ে যায়, তাহলে সংসদ কার্যকর হবে না।

বড় দলগুলোর প্রার্থী তালিকা দেখে তেমন আশাবাদী হতে পারছি না। মুখে তাঁরা যা-ই বলুন না কেন, যতই পৃথিবীর সুন্দর শব্দাবলি চয়ন করে ইশতেহারে ঠেসে দিন না কেন, রাতারাতি কি তাঁদের স্বভাব বদলাবে?

 মহিউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল–বিষয়ক গবেষক