মনোনয়নপত্র বাছাই

রিটার্নিং কর্মকর্তারা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। মনোনয়নপত্র বাছাইপর্বটি যাতে বিতর্কমুক্ত ও আইনসংগত হয়, সেটা নিশ্চিত করতে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের আইনে বিরাট ভূমিকা নিশ্চিত করেছে। আমরা সাধারণত নির্বাচন কমিশনের শক্তিশালী ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করতে বেশি মনোযোগী ও অভ্যস্ত। অথচ যোগ্য প্রার্থী যাচাইয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ তাঁদের রীতিমতো বিচারকের আসনে বসিয়েছে।

 কোনো কারণে হলফনামায় আটটি তথ্যের ভুল তথ্য প্রদানের জন্য তাঁরাই মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারেন। কারণ আইন বলেছে, রিটার্নিং কর্মকর্তা তাঁর স্বীয় উদ্যোগে বা কারও আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে সংক্ষিপ্ত তদন্ত পরিচালনা করে মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারবেন। শুধু তা-ই নয়, হলফনামায় প্রদত্ত কোনো তথ্য মিথ্যা বা ভুল বলে প্রমাণিত হলে তার প্রতিকারে মামলা দায়ের করতে পারবেন। দণ্ডবিধির ১৮১ ধারা অনুযায়ী মনোনয়নপত্র যাচাইয়ে অসত্য তথ্য দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ জন্য অনধিক তিন বছরের জেল ও জরিমানার বিধান আছে। এ বিষয়ে নিরপেক্ষভাবে যথা উদ্যোগ এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে তাঁরা কতটা সফল হন, সেটা দেখতে জনগণ তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকবে।

 আমরা আশা করব, হলফনামা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের বাইরে টাঙিয়ে দেওয়ার বিধান যেন একটি নামকাওয়াস্তে আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত না হয়। হলফনামার তথ্যগুলো লিফলেট আকারে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের মধ্যে বিতরণ ও প্রচার করাও রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব। আইনের চোখে সবাই যে সমান, সেটি নিশ্চিত করতে হবে তাঁদের। প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনটি লাভজনক পদ ও কোনটি নয়, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন অস্পষ্টতা বজায় রেখেছে। কিন্তু আমরা আশা করব এ ক্ষেত্রে যেন একই বিষয়ে এলাকাভেদে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত না হয়। মেয়র বা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদে থেকে কারও প্রার্থিতা গ্রহণ বা বাতিলের ঘটনা যেন না ঘটে। এভাবে অন্যান্য আইনি প্রশ্নে রিটার্নিং কর্মকর্তারা যদি ব্যক্তি ও এলাকাভেদে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত তাঁরা দেন, তাহলে তা সার্বিকভাবে গোটা নির্বাচন পরিচালনার নৈতিকতা নির্বাচনের আগেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

একজন প্রার্থী বর্তমানে কোনো ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত আছেন কি না, অতীতে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা কোনো ফৌজদারি মামলা রেকর্ড আছে কি না, থাকলে মামলার রায় কী ছিল, সেটা হলফনামায় থাকতে হবে। প্রার্থীরা অতীত গোপন করার প্রবণতা দেখাতে পারেন। কিন্তু মানুষের তা জানার অধিকার আছে। এটা গোপন করা হলে মনোনয়নপত্র বাতিলযোগ্য হবে। আবার কারও পেশার বিবরণী, সম্ভাব্য আয়ের উৎস তাঁর নিজের ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের পরিসম্পদের বিবরণীতে তথ্য গোপনের আশঙ্কা থাকবে। এসব তথ্যের প্রকাশ স্বার্থের সংঘাতগুলো ভোটারদের সামনে স্পষ্ট করবে।

আগের নির্বাচনে কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং কী পরিমাণ অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল তার বিবরণী, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রার্থী নিজে বা যৌথভাবে বা তাঁর ওপর নির্ভরশীল সদস্য কর্তৃক গৃহীত ঋণের পরিমাণ সম্পর্কে ভোটারদের অবগত করানোটা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব। ভোটের উদ্দেশ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তারা সত্যিকার অর্থেই নির্বাচনী বিচারক ও প্রশাসক।

ভোটের দিনে তাঁরা কী করবেন, সেটা নিশ্চয় বড় বিষয়, কিন্তু মনোনয়নপত্র বাছাইপর্বে তাঁরা আইনসংগত ভূমিকা পালন করে উত্তম নজির স্থাপন করতে পারেন। দলীয় সরকারের অধীনেই যে আইনের শাসন কার্যকর করে নতুন নজির স্থাপন করা যায়, সে বিষয়ে তাঁরা জনগণকে ভরসা দেবেন। ইতিহাসে প্রথম দলীয় সরকারের অধীনে একটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এর গ্রহণযোগ্যতার অনেকটাই রিটার্নিং কর্মকর্তারা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে প্রাক্‌-নির্বাচনপর্বে জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে পারেন।