অন্ধত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করুন

এক দশকজুড়ে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিছুদিন আগে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বার্ষিক বৈঠকে প্রকাশিত মানবসম্পদ সূচকে (এইচসিআই) বাংলাদেশের অবস্থান বেশ সন্তোষজনক। স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে জাতীয় কর্মক্ষমতা পরিমাপকারী সূচকটি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে এই দেশের অর্জনকে প্রতিফলিত করে, যা প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় অনেক এগিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে এবং এর ফলে অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ, শিক্ষা এবং যোগাযোগ ও পরিবহন নেটওয়ার্কের উন্নয়নের বিস্তৃতি ঘটেছে, ঘটছে। এত সব সাফল্যের পরও এখনো অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে আমরা আরও কিছু করতে পারি। যেমন অন্ধত্ব প্রতিরোধ।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষ অন্ধত্বের শিকার এবং লাখ লাখ লোক চোখের ব্যাধিতে ভুগছে। অন্ধত্ব এবং চোখের ব্যাধি মানুষের অফুরান সম্ভাবনাকে সীমিত করে, শিক্ষা অর্জন ও জীবিকার নানা সুযোগ-সুবিধাকে বাধাগ্রস্ত করে। আর এই সবকিছুই দীর্ঘ মেয়াদে ব্যক্তি, পরিবার এবং সম্প্রদায়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, সুচিকিৎসার মাধ্যমে ৮০ শতাংশ অন্ধ মানুষকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

তাহলে এখনো কেন এই সংখ্যা এত বেশি? অনেক কারণই আছে। তবে সচেতনতার অভাব হচ্ছে প্রধান কারণ। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলেই বিষয়টি বোঝা যাবে। ৯০ বছর বয়সী আমেনা ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে বসবাস করেন। পাথর ভেঙে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। আমেনা যখন প্রথমে চোখের সমস্যায় ভুগতে শুরু করেন, তখন তিনি ভেবেছিলেন এটি একটি সাধারণ সমস্যা। তিনি বিষয়টিকে খুব বেশি পাত্তা দেননি। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তাঁর চোখের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকল এবং দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গেলেন! পরে সাইট সেভারস ইন্টারন্যাশনাল-সমর্থিত প্রতিষ্ঠান দৃষ্টি কেন্দ্রের একটি কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারলেন যে তাঁর অবস্থাটি চিকিত্সাযোগ্য ছিল এবং সময়মতো চিকিৎসা করলে তিনি সম্পূর্ণভাবে সুস্থও হয়ে যেতেন।

অসচেতনতা এ দেশের রোগীদের চোখের অস্ত্রোপচার করতেও নিরুৎসাহিত করে। বরিশালের বাকেরগঞ্জের ছোট গ্রাম দশপাড়া। সেখানে একটি চক্ষু শিবিরের মাধ্যমে দ্য ফ্রেড হলোস ফাউন্ডেশন আবিষ্কার করে যে সেখানকার বেশির ভাগ লোকেরই চোখে ছানি পড়েছে। কিন্তু ছানি কাটানোতে গ্রামের কেউ সম্মত হচ্ছিল না। পরে স্থানীয় প্রফুল্ল বিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষ ইভা রানি দত্তের সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কার্যক্রমের ফলে তাঁরা এই সহজ অস্ত্রোপচার করতে রাজি হন এবং এখন সেখানে সবাই সুস্থ রয়েছেন।

এ তো গেল অসচেতনতার সমস্যা। দ্বিতীয় কারণটি হলো চিকিৎসার খবর দূরবর্তী ও প্রান্তজনের কাছে পৌঁছানো। কারণ, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করে এমন ফ্রেন্ডশিপ ভাসমান হাসপাতালগুলোর একটি উপকূলে চক্ষু স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার সময় আমরা একটি বিষয় লক্ষ করেছি। একটি জরিপে দেখা যায়, ৮০ শতাংশ রোগী বলেছেন যে চক্ষু স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এই কর্মসূচি না থাকলে তাঁরা সেবাহীনই থাকতেন।

এ ধরনের ঘটনাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। চক্ষু স্বাস্থ্য শিবিরের মধ্যেই আমরা এই গল্পগুলো খুঁজে পাই, যেখানে স্পষ্ট হয় যে কীভাবে চোখের ছোট একটি সমস্যা মানুষের দৃষ্টিশক্তিকে নষ্ট করে দিতে পারে। আর এই গল্পগুলোই স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশকে অনুপ্রাণিত করেছে; যার ফলে ১৫ বছর আগে ২০০৩ সালে ইস্পাহানি ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউট এবং হাসপাতালের সঙ্গে প্রথম চক্ষু স্বাস্থ্য কর্মসূচি চালু করে। এই কর্মসূচিটি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের বিশ্বব্যাপী ফ্ল্যাগশিপ কমিউনিটি এনগেজমেন্ট প্রোগ্রাম ‘সিয়িং ইজ বিলিভিং’কে আলোড়িত করেছে।

গত ১৫ বছরে সিয়িং ইজ বিলিভিং কর্মসূচিতে আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে পাশে পেয়েছি। ইসলামিয়া, আইএপিবি, সাইট সেভারস, অরবিস ইন্টারন্যাশনাল, হেলেন কেলার ফাউন্ডেশন, ফ্রেড হলোস ও ফ্রেন্ডশিপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় আমরা ১৪ লাখের বেশি মানুষের অন্ধত্বের সমস্যায় পাশে দাঁড়িয়েছি। অন্ধত্বের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই পুরোদমে চালু রয়েছে এবং সবাইকে নিয়েই ভিশন ২০২০-এর লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। এটি এমনই একটি লক্ষ্য, যা আমাদের জিততেই হবে।

বিটপী দাশ চৌধুরী: স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, ব্র্যান্ড ও মার্কেটিংয়ের প্রধান