তিন দফা থাকতে হবে

কোন তিন দফা? কত দফাই তো ভেসে গেল, এখন আবার কোন দফা?

জানি, অনেকে এ রকমই ভাববেন। এখন সব দল ও জোট ইশতেহার তৈরি করছে। অনেকের করা শেষ। সেখানে অনেক বড় বড় কথা থাকবে জানি। উন্নয়ন, বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি, আয়-আয়ু বৃদ্ধি। দেশে আর গরিব থাকবে না। কত কিছু।

এগুলো তো থাকতে হবেই। তবে অন্তত তিনটি বিষয়ে যেন গুরুত্ব দেওয়া হয়। আপনি যদি ক্রাউড সোর্সিং করেন, আর দেশের অর্ধেক নারীসমাজের মতামত নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন, তাহলে প্রায় শতভাগ বলবে নারী নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা। শুধু নারী কেন, শহরের বস্তি, গ্রামের গরিব জনগোষ্ঠী একই কথা বলবে।

ঘরে-বাইরে নারী নির্যাতন চলছে। বাসে নারীদের নির্যাতন, এমনকি হত্যা করা হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, নির্যাতিত নারীদের মামলার মাত্র ৩ শতাংশ ক্ষেত্রে বিচার ও অপরাধীর শাস্তি হয়। ৯৭ ভাগ মামলার শুনানিই হয় না। এই যদি হয় দেশের অবস্থা, তাহলে উন্নয়ন হবে কীভাবে?

তাই নির্বাচনী ইশতেহারে পরিষ্কার লিখে দিন যে নারী নির্যাতনকারী, বাল্যবিবাহে মদদদানকারী, মাদক ব্যবসায়ী কোনো ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেব না। আর ইতিমধ্যে দেওয়া হয়ে থাকলে প্রত্যাহার করে নিন। এখনো সে সময় আছে। নৈতিক স্খলনের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তারা প্রার্থীর আবেদন বাতিল করতে পারেন। কিন্তু নৈতিক স্খলনের বিস্তৃত সংজ্ঞা নেই। এটা অবিলম্বে করা দরকার। শুধু দুর্নীতি, ঋণখেলাপ নয়, নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি বিদ্বেষ, বৈষম্য—এসবই নৈতিক স্খলন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। ভারতে এটা করা হয়েছে।

 নারী নির্যাতনকারীদের আইন প্রণয়নকারী হতে দেওয়া যাবে না। তাঁদের নির্বাচনে আসতে দেওয়া যাবে না। এটাই মূল কথা। এ রকম তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পরপর চার দিন প্রথম আলোর উদ্যোগে গোলটেবিল বৈঠক হয়ে গেল। আমাদের সঙ্গে ছিল বেশ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থাও ছিল। অ্যাকশনএইড, ইকো কো-অপারেশন, আইআইডি, ইউএনএফপিএসহ আরও কিছু সংস্থা। ওরা কাজ করে নারী নির্যাতন রোধে কার্যকর উপায় নিয়ে। প্রবাসী কর্মী ও অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে। খাদ্য অধিকার আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়েও তারা কাজ করে। তারা মনে করিয়ে দিয়ে গেল, নির্বাচনী ইশতেহারে এই বিষয়গুলো যেন জোরেশোরে আনা হয়।

বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইডের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে সেদিন আইনজীবী তানিয়া আমীরের কথাগুলো আমাদের চোখ খুলে দিল। একদম ঠিক। প্রভাবশালী কেউ একজন বউ পেটাবেন, যৌতুকবাজি করবেন, আবার নির্বাচনও করবেন? সেটা তো হতে পারে না। প্রার্থীকে হতে হবে ‘ক্লিন পারসন’। এর ওপরে কথা নেই।

যেমন ধরা যাক বিদেশে যাঁরা কাজ করতে যাচ্ছেন তাঁদের কথা। ওরা কেমন আছেন? বিশেষভাবে নারী শ্রমিকদের সমস্যা প্রকট। ওদের মানসম্ভ্রমও খোয়াতে হয়। সেই সব করুণ কাহিনি আমরা জানি। প্রতিকার কী? বেসরকারি সংস্থা আইআইডির সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বেশ কিছু প্রস্তাব আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার আগে প্রত্যেক কর্মী নিজ নিজ এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনে নাম রেজিস্ট্রি করিয়ে যাবেন। কোথায়, কোন ঠিকানায়, কার মাধ্যমে যাচ্ছেন, তার একটা ডেটাবেইস থাকবে। কেউ প্রতারিত হলে সেই ডেটাবেইস থেকে তথ্য বের করে তাঁকে সরকার সহায়তা দিতে পারবে।

ধারকর্জ করে, জমি বিক্রি করে হয়তো যাচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের অনেকে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। তাঁদের বেশির ভাগই শিক্ষাবঞ্চিত। গ্রামের পরিচিত কারও মাধ্যমে বিদেশে চাকরির ভিসা সংগ্রহ করেছেন। সেই ভিসা কিনতে হয়েছে লাখ লাখ টাকায়। যদিও সরকারের কথা অনুযায়ী সেটা ৩০ বা ৫০ হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তব হলো, একশ্রেণির দালালের পাল্লায় পড়ে তাঁদের সব খোয়াতে হয়। এর কি প্রতিকার নেই? বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোকে এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। সরকার অবশ্য বলছে বিদেশে কর্মীদের সহায়তার জন্য বিশেষ উদ্যোগের কথা। কিন্তু আসলে তো সব দূতাবাসে জনবলের ঘাটতি একটা বিরাট সমস্যা।

আমরা সব সময় বলি প্রশিক্ষণের কথা। একটু প্রশিক্ষণ থাকলে বিদেশে উন্নত মানের চাকরি করতে পারবে। ভালো বেতন ও মর্যাদা পাবে। এটাই আমাদের সাধারণ ভাবনা। কিন্তু আমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছি, কর্মীরা মালয়েশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যে কোন পদের ভিসায় চাকরি করতে যায়? ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ফর রাইটস অব বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্টসের (ওআরবি) চেয়ারম্যান বললেন, এই সব ভিসা তো সাধারণ লেবারের ভিসা। এই ভিসায় প্রধানত ক্লিনারের কাজই জোটে। সেখানে উন্নত মানের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কোন উপকারটা আমরা করতে পারব? চাকরির ভিসা তো ক্লিনারের। তাই দেখা যাচ্ছে গোড়ায় গলদ। আমরা দেখছি না, ভিসা কে আনছে আর কোন ধরনের ভিসা আনা হচ্ছে। আমাদের দরকার উন্নত মানের চাকরির ভিসা। আর তখনই কর্মীদের উন্নত মানের প্রশিক্ষণ কাজে লাগবে। দেশের মানুষ বিদেশে মর্যাদাপূর্ণ কাজ পাবে। আর সেটা করার অঙ্গীকার আজ রাজনৈতিক দলগুলোকে করতে হবে। তাদের ইশতেহারে এর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রায় দেড় কোটি কর্মী বিদেশে চাকরি করছেন। তাঁদের সঙ্গে জড়িত প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ। ওঁদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রায় ৮ শতাংশ জোগান দেয়। যদি একটু ভালো প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও উন্নত মানের চাকরিতে তাঁদের পাঠানো হয়, তাহলে রেমিট্যান্স এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ইশতেহারে আরেকটা বিষয় আনতে হবে। খাদ্য অধিকার আইন যেন আগামী সংসদে পাস হয়। আমাদের দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অভুক্ত কেউ নেই। কিন্তু অধিকারের প্রশ্ন অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ মনে করিয়ে দিয়েছেন, শুধু তিন বেলা ভাত খাওয়াই যথেষ্ট নয়। সুষম খাদ্য ও পুষ্টিও চাই। আর তা ছাড়া আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্য রয়েছি। সে কথা ভুলে গেলে চলবে না।

সেদিন আলোচনায় অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেছেন, আমাদের সোশ্যাল সেফটি নেট রয়েছে। সেই সহায়তা প্রকৃত দরিদ্রদের কাছে পৌঁছানোর ডিজিটাল ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। এটা সুসংবাদ। অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেছেন, সরকারের কার্যক্রমগুলোকে একটি
সমন্বিত কর্মসূচির মধ্যে আনতে হবে। যেন কেউ বঞ্চিত না হয়।

আমরা এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য অঙ্গীকার করেছি। এর অনেক বিষয়ের মধ্যে মূল কথাই হলো দারিদ্র্য কমিয়ে আনা। কেউ যেন পেছনে পড়ে না থাকে।

আমাদের কথা হলো, এই তিন দফা যেন পানিতে না পড়ে। এগুলো গণমানুষের দাবি।

আব্দুল কাইয়ুম, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক