গড়াচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রথ

ব্যর্থতা ঢাকতে নরেন্দ্র মোদি বাধ্য হচ্ছেন উগ্র হিন্দুয়ানার রথে চেপে বসতে। রয়টার্স ফাইল ছবি
ব্যর্থতা ঢাকতে নরেন্দ্র মোদি বাধ্য হচ্ছেন উগ্র হিন্দুয়ানার রথে চেপে বসতে। রয়টার্স ফাইল ছবি

ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও মিজোরাম—তিন রাজ্যের ভোট শেষ। বাকি রইল রাজস্থান ও তেলেঙ্গানা। ডিসেম্বরের ৭ তারিখ ওই দুই রাজ্যের ভোট মেটার সঙ্গে সঙ্গে সাঙ্গ হবে সেমিফাইনালের লড়াই। ভারতের ভোটচিত্র এরপর প্রতীক্ষায় থাকবে আসছে বছরের এপ্রিল-মে মাসের ফাইনালের জন্য। লোকসভার সেই ভোটে আঁকা হবে নরেন্দ্র মোদি ও রাহুল গান্ধীর পাশাপাশি ভারতের আঞ্চলিক নেতাদেরও রাজনৈতিক ভাগ্য।

পাঁচ রাজ্যের ভোটের পর ফল বেরোবে ১১ ডিসেম্বর। ওই দিনই শুরু হচ্ছে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। চোখ বুজে তাই বলে দেওয়া যায়, শীতের অধিবেশন কতখানি তপ্ত হয়ে উঠবে। বিজেপির হাত থেকে রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশ কেড়ে নিতে পারলে কংগ্রেস সেই অধিবেশনে সরকারপক্ষকে তিষ্টোতে দেবে না। রাফাল, সিবিআই, এনআরসি, নাগরিকত্ব বিল, কাশ্মীর, প্রাতিষ্ঠানিক ‘মর্যাদাহানি’, অযোধ্যাকেন্দ্রিক উগ্র হিন্দুত্ববাদ ইত্যাদি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি ও তাঁর সরকারকে ছিঁড়ে খাবে উজ্জীবিত কংগ্রেস। শাসক দল কীভাবে তার মোকাবিলা করবে, তা দেখতে দেশবাসী উৎসুক। এই সাড়ে চার বছর ধরে ফাঁকা মাঠে গোল করার মতো বিজেপির একতরফা জয় দেখতে দেখতে চোখ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। এই প্রথম সম্ভবত তার ব্যতিক্রম ঘটতে চলেছে। ক্ষমতার শেষ বছরটা মোদির বিজেপির কাছে তাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

মোদি ও তাঁর দল তা বিলক্ষণ বুঝেওছে। আর সেই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ সেমিফাইনালের এই লড়াইকে বিজেপি কিছুতেই মোদি বনাম কংগ্রেসে পরিণত করতে চায়নি। এ কথা অবশ্যই ঠিক যে, গো-বলয়ের এই তিন বিজেপিশাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা মোটেই মোদিনির্ভর নন। মোদি জমানা শুরুর অনেক আগে থেকেই তাঁরা নিজ নিজ ক্ষমতায় রাজ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। রাজস্থানের বসুন্ধরা রাজে, ছত্তিশগড়ের রমণ সিং কিংবা মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিং চৌহানের মৌরসি পাট্টা জারি রয়েছে নরেন্দ্র মোদির উদয়ের অনেক আগে থেকেই। রাজ্য রাজনীতিতে তাঁদের মাথা মোদির চেয়েও উঁচু। চ্যালেঞ্জ তীব্র জানা সত্ত্বেও বিজেপি তাই প্রধানমন্ত্রীকে এই তিন রাজ্যে সেইভাবে ব্যবহার করেনি, যাতে মনে হতে পারে, লড়াইটা হচ্ছে মোদি বনাম রাহুল গান্ধীর কংগ্রেসের মধ্যে। যে গুজরাটকে দখলে রাখতে রাজ্যের ভূমিপুত্র নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহর মোট জনসভা হাফ সেঞ্চুরি পেরিয়ে গিয়েছিল, সেই জুটি এবার এই তিন রাজ্যে সেভাবে ঘাম ঝরায়নি। এর একটা কারণ যদি হয় রাজ্যগুলো হাতছাড়া হওয়ার তীব্র আশঙ্কা, অন্য কারণ তবে নিজেদের মুখ বাঁচানোর রাস্তাটা খুলে রাখা।

তিন রাজ্যের মধ্যে অন্তত দুটি ধরে রাখতে পারলে টিম মোদির পোয়াবারো। কিন্তু তা না হলে কংগ্রেসের পালে বাড়তি হাওয়া অবশ্যই লাগবে। সেমিফাইনালের এই প্রচারপর্বে মোদি অন্তত এটুকু স্বীকার করে নিয়েছেন, এত দিন ধরে তাঁর কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়ার ডাকের অসারত্ব কতখানি। প্রতিটি রাজ্যে প্রতিটি জনসভায় মোদির আক্রমণের তির স্রেফ কংগ্রেসের দিকে ধেয়ে গেছে। এমনকি একেবারে শেষবেলায় তেলেঙ্গানায় প্রচারে গিয়ে তিনি এ কথাও বলতে ছাড়েননি, মমতা টিকে থাকবেন, অখিলেশ-মায়াবতীও, কিন্তু কংগ্রেস টিকবে না। কারণ, জনতার কাছে কংগ্রেসের বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্যতা নেই। এর মধ্য দিয়ে এটুকু তিনি বুঝিয়ে দিলেন, এই দেশে বিজেপির প্রতিপক্ষ এখনো কংগ্রেস এবং সেই কংগ্রেসের নেতৃত্ব রাহুল গান্ধীর হাতে। বস্তুত নেতা হিসেবে রাহুলকে যে মান্যতা নরেন্দ্র মোদি দিয়েছেন, রাজীব-তনয়ের সে জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

এবারের ভোট আরও একজনের কাছে বিপুল গুরুত্বের। দলিত নেত্রী মায়াবতী। সিবিআইয়ের জুজু দেখিয়ে বিজেপিই যে চাপ দিয়ে তাঁকে এই তিন রাজ্যে কংগ্রেসের হাত ধরতে দেয়নি, এই রাজনৈতিক ধারণা বিরোধীদের কাছে মোটামুটি স্বীকৃত সত্য। মায়াবতীর কারণে ভোট ভাগাভাগির খেলায় মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপি সফল হলে রাহুলের চাপ নিশ্চিতই বাড়বে। ফাইনালের আগে তাঁকে আরও নমনীয় হতেই হবে। কিন্তু তা না হলে, কংগ্রেস যদি মাইনাস মায়াবতী কেল্লা ফতে করে, সবচেয়ে ক্ষতির মুখোমুখি তা হলে দাঁড়াবেন দলিত নেত্রীই। নানা কারণে মায়াবতীর ধার ও ভার দক্ষিণমুখী। উত্তর প্রদেশে মাথাচাড়া দিয়েছে নতুন দলিত নেতৃত্ব। হু হু করে বাড়ছে ‘ভীমসেনা’র প্রতিষ্ঠাতা তরুণ দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদের জনপ্রিয়তা ও প্রভাব। গুজরাটের দলিত নেতৃত্বও ইতিমধ্যেই মুঠোয় পুরেছেন ডাকাবুকো তরুণ জিঘ্নেশ মেওয়ানি। গো-বলয়ে এঁরা সবাই ছড়িয়ে দিচ্ছেন নিজের প্রভাব। বিজেপির চাপে গুটিয়ে থাকলে মায়াবতী তাই নিজের পায়েই কুড়াল মারবেন। এই ভোট তাঁর কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ।

একটি জরিপ দেখাচ্ছে, ২০১৯-এর ফাইনালে বিজেপি একক গরিষ্ঠ দল হলেও ২০১৪ সালের মতো নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা থেকে অন্তত এক শ আসন দূরে থাকবে। অর্থাৎ ১৮০ আসনের আশপাশে ঘোরাফেরা করবে তাদের মোট আসনসংখ্যা। সেই ক্ষেত্রে সরকার গড়তে তাদের নির্ভর করতে হবে অন্য আঞ্চলিক দলের সমর্থনের ওপর। তেলেঙ্গানায় গিয়ে মোদির এই যে মমতাস্তুতি, কিংবা মায়াবতী-অখিলেশের পিঠ চাপড়ানো, এর লক্ষ্যও যে তা, সেই চর্চা শুরু হয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠছে, সেই সময় সমর্থনের শর্ত হিসেবে শরিকেরা যদি নেতা বদলের দাবি খাড়া করে, কী সিদ্ধান্ত নেবে সংঘ পরিবার? ক্ষমতায় থাকতে নিতিন গড়কড়ি অথবা রাজনাথ সিং কিংবা সুষমা স্বরাজকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেবে নাকি নরেন্দ্র মোদিতেই অটল থাকবে? রাজনৈতিক বৃত্তে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা প্রবল।

তা যাতে না হয় সে জন্য সংঘ পরিবার সুচতুরভাবে জমি তৈরিতে নেমে পড়েছে। অযোধ্যায় এই যে মন্দির তৈরির তৎপরতা বাজার গরম করে তুলেছে, এর উদ্দেশ্যও ধর্মীয় মেরুকরণ। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এমন এক সুউচ্চ রামমূর্তি তৈরির পরিকল্পনা করেছেন, যার কাছে বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তিও খাটো লাগে। শুরু করা হচ্ছে নানা যাত্রা। চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে সরকারের ওপর, যাতে সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় না থেকে অর্ডিন্যান্স জারির মধ্য দিয়ে রামমন্দির তৈরির কাজ শুরু করে দেওয়া যায়। উগ্র হিন্দুত্ব বরাবরই বিজেপিকে রাজনৈতিক লাভ এনে দিয়েছে। আগামী বছরের ফাইনাল জিততে কংগ্রেসের নরম হিন্দুত্বের মোকাবিলায় বিজেপির সেরা হাতিয়ার তাই উগ্র হিন্দুত্ব। উন্নয়ন, সংস্কার, প্রগতি ও কর্মসংস্থানের যাবতীয় দাবিতে রাজনৈতিক চিড়ে না ভিজলে এ ছাড়া উপায়ই-বা কী?

‘অচ্ছে দিন’ তিনি এনে দিতে পারেননি। নরেন্দ্র মোদির চেয়ে বেশি ভালো তা আর কেউ উপলব্ধি করেন না। ‘অচ্ছে দিন’ না আনার পাশাপাশি ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ও ঘটেনি। ব্যর্থতা ঢাকতে হীনবল কংগ্রেসকে যত আঘাত তিনি দিয়েছেন, ততই প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন শতাব্দীপ্রাচীন এই দলটিকে। মোকাবিলায় ব্যর্থ মোদি বাধ্য হচ্ছেন উগ্র হিন্দুয়ানার রথে চেপে বসতে। সাড়ে চার বছর ধরে নিজেকে প্রতিষ্ঠার এমন দুর্লভ সুযোগ পেয়েও আজ তিনি নিজেই নিজের সামনে খাড়া করে ফেলেছেন সুউচ্চ এক প্রাচীর। সেই বাধা টপকাতে পারবেন কি না, পাঁচ রাজ্যের ভোট সেই আন্দাজ দেবে।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি