৩০০ আসামির নির্বাচন

আমার কাছে নানা ধরনের ফোন আসে। কোনো কোনো ফোন আসে পরামর্শের জন্য। কিছু মানুষের ধারণা পরামর্শের জন্য আমি একজন খাঁটি মানুষ। আসলে তা নয়। তা ছাড়া বাংলাদেশে কিছু বিষয় ঘটে যেখানে পরামর্শ দেওয়ার সুযোগও থাকে না কোনো।

কিছুদিন আগে ফোন করলেন শিরিন সুলতানা। তিনি বিএনপি নেতা খায়রুল কবীর খোকনের স্ত্রী, নিজেও রাজনীতিতে জড়িত। বিএনপির শিরিন, খোকন বা আওয়ামী লীগের অসীম কুমার উকিলদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সময় থেকে।

শিরিন ফোন করেছিলেন আইনি পরামর্শের জন্য। তাঁর স্বামী খায়রুল কবীর খোকন প্রায় অর্ধশত মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিনে ছিলেন। কিন্তু তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা নতুন করে সচল করা হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি দায়ের করা এই মামলার এজাহারে তাঁর নাম ছিল না। কিন্তু নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে ২৫ নভেম্বর দায়ের করা পুলিশের অভিযোগপত্রে তাঁর নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ৮৭ নম্বর আসামি হিসেবে। ২৯ নভেম্বর তিনি আর বিএনপির দুজন স্থানীয় নেতা জামিন নিতে বিচারিক আদালতে যান। জামিন হয় সেই দুজন নেতার, জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কেবল ৮৭ নম্বর আসামি খায়রুল কবীরকে। উদ্বেগাকুল শিরিন জানতে চান, এমন হলে কী করার আছে তাঁদের।

আমার নিজেরই আসলে জানা নেই কী করার আছে এখানে। আমি তাঁকে পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি। কিন্তু তাতে কি কোনো লাভ হবে আসলে? পত্রিকাতেই পড়ি শুধু খোকন না; আরও কয়েকজন নির্বাচনী প্রার্থীকে গত কয়েক দিনে জামিন নামঞ্জুর করে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে মাগুরা-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী রয়েছেন। যাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধানমন্ত্রীর অফিসের একজন কর্মকর্তা, যিনি নিজেই লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত কি না এবং এ কারণে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য কি না, এ প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। অন্য একটি আসনে বিএনপির প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান সরকারের একজন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বহু অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পরও যাঁকে কখনো কোনো সাজা ভোগ করতে হয়নি; বরং নির্বাচনের ঠিক আগে জেলে যেতে হয় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে।

ভবিষ্যতে এমন অবস্থা হতে পারে আরও অনেক আসনে। সরকার চাইলে এমনকি বিএনপির সব প্রার্থীকেই জেলে ভরে দিতে পারে নির্বাচনের আগে আগে। দেশের ৩০০টি নির্বাচনী এলাকায় বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে। অনেক মামলায় ঢালাওভাবে বিপুলসংখ্যক ‘অজ্ঞাতনামা’ ব্যক্তিকে আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। খায়রুল কবীর খোকনের মতো করে যেকোনো প্রার্থীকে এসব মামলায় এখন অভিযোগপত্রে নাম ঢুকিয়ে জেলে বন্দী করে ফেলা সম্ভব। অভিযোগপত্র দাখিল হয়ে গেলে সম্পূরক অভিযোগপত্রে নাম ঢোকানোর সুযোগও রয়েছে। যতই গায়েবি মামলা হোক, যতই ঢালাও অভিযোগপত্র হোক, বিচারিক আদালতে এসব মামলায় জামিন হয়-এমনটাও আমরা এখন দেখি না আর সাধারণত।

কাজেই নির্বাচনের আগে বিএনপির বাকি অনেক প্রার্থীকে জেলে ঢুকিয়ে একতরফা নির্বাচন করার চেষ্টা চাইলে করতে পারে সরকার। জেলে ঢোকানোর আগে-পরে বিএনপির সমর্থকেরা প্রতিবাদ করলে তাঁদের ওপর হামলা হতে পারে, হামলা করে উল্টো তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও হতে পারে। এমন নজির দেখা গেছে দেশে, এমনকি অরাজনৈতিক আন্দোলনের সময়ও।

তবে বিএনপির ৩০০ প্রার্থীই জেলবন্দী-এতটা আসলে হবে না। জোটসঙ্গীদের জন্য কিছু আসন ছেড়ে দিতে হবে বলে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করবে না বিএনপি (এই লেখা লেখার সময় দেখি তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে কিছু আসনে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগই হরণ করে ফেলেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা)। কমবেশি আড়াই শ আসনে বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে সব আসনের প্রার্থীকেই জেলে ঢোকানো হবে-এমন অরাজকতা হওয়ার আশঙ্কাও খুব কম। কিন্তু যেকোনো আসনেই এমন ঘটনা ঘটতে পারে, এই আশঙ্কাটা থাকবে বিএনপির প্রার্থীদের। বিশেষ করে যেসব আসনে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দাঁড়িয়েছেন সরকারি দল থেকে, সেখানে এই আশঙ্কা আরও প্রবল হওয়ার কথা।

প্রার্থীদের পাশাপাশি কর্মীদের অবস্থাও শোচনীয়। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও বিভিন্ন মামলায় বিএনপির শত শত কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আরও গ্রেপ্তার করার জন্য রাত-বিরাতে অভিযান চলছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতে উচ্চ আদালতে দলে দলে লোক এসে জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেখানে জামিন পেলেও গায়েবি আর ভুয়া মামলায় ঢালাওভাবে যে কাউকে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করার মতো পরিস্থিতি পুলিশ প্রশাসনে রয়েছে।

কাজের ক্ষেত্রেও পুলিশের পক্ষপাতিত্বের বহু ঘটনা আমরা দেখেছি আগে। সরকারপক্ষের লোক হামলা করলে মামলা হয় না, মামলা হলেও ঢালাওভাবে আসামি করা হয় না, নাম-ঠিকানার আসামিরও হদিস পাওয়া যায় না, তাদের খুঁজতে রাতের বেলা বাড়ি বাড়ি অভিযান চালানোর খবর পাওয়া যায় না। বিরোধী দলের বেলায় ঘটে পুরো উল্টো ঘটনা। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও এসব চিত্রের পরিবর্তন হয়নি কোনো; বরং সাম্প্রতিক কিছু নজিরবিহীন ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা হয়েছে আরও প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন: তারা নিজে থেকে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে, এমন সংবাদ পত্রিকায় এসেছে। এই পুলিশ তাহলে নির্বাচনের দিন কী করবে?
আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে পুলিশ নাকি এখন কাজ করছে একটি ‘নির্বাচনকালীন’ সরকারের সময়ে। নির্বাচন কমিশন নিজেই বলেছে, পুলিশ কাজ করছে তাদের নিয়ন্ত্রণে থেকে। আমার প্রশ্ন এখানেই। আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের পুলিশ আর নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশের কাজে তাহলে পার্থক্য কোথায়? কী ব্যবস্থা নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন পুলিশের ভূমিকা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য রাখার জন্য? আসলে কি কিছু করার নেই তাদের এ ক্ষেত্রে?

বাংলাদেশের সংবিধান হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন। এই সংবিধান অনুসারে নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব পালনে সহায়তা করার ‘কর্তব্য’ রয়েছে জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের। ভারতের বহু রায়ে এবং বাংলাদেশেরও কিছু রায়ে এর ব্যাখ্যা হয়েছে এমন যে: সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের এবং এই ক্ষমতা প্রয়োগে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার দায়িত্ব রয়েছে সরকারের অন্য সবার।

নির্বাচন কমিশন কি করতে পারত তাহলে? এ দেশের অতীত রেওয়াজ অনুসারে তারা নির্বাচনের আগে আগে পুলিশ ও প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল আনতে পারত। পারত পুলিশের বড় কর্তাদের ডেকে সতর্ক করতে। বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট দাবি করেছিল নির্বাচনকালীন প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখার, কাউকে নতুন করে গ্রেপ্তার না করার। চাইলেই পুলিশ ও ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি কৌঁসুলিদের এমন নির্দেশ দিতে পারত নির্বাচন কমিশন। যে দেশে সরকারের মিত্র হলে হত্যা মামলা ঝুলে থাকে কয়েক দশক, সরকারের লোক হলে আদালতের সাজা স্থবির হয়ে থাকে বছরের পর বছর, সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কয়েকটা সপ্তাহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি কার্যক্রম স্থগিত থাকলে সমস্যা কোথায়? ঢালাও, ভুয়া ও গায়েবি ধরনের মামলাগুলোতে এসব তো করাই সংগত।

নির্বাচন কমিশন দৃঢ়ভাবে চাইলে সবই সম্ভব। আমার প্রশ্ন, চাচ্ছে না কেন তারা এসব? কেন তারা বরং সায় দিচ্ছে কোনো কোনো বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব গ্রহণে। নির্বাচনের আগে সুস্থ একটি পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য পুলিশকে অবশ্যই দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। না হলে নির্বাচন কোনোভাবেই সুষ্ঠু আর বিশ্বাসযোগ্য হবে না।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক