অরিত্রী আমাদের ব্যবস্থার শিকার

আবুল মোমেন
আবুল মোমেন

কিশোরী অরিত্রীর আত্মহনন তার পরিবারের জন্য মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি বটে, তবে এর মাধ্যমে আমাদের শিক্ষারও ট্র্যাজেডির দিক প্রকাশ পায়। এ ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে স্কুলশিক্ষায় ছাত্র-শিক্ষক যে ঘনিষ্ঠ মানবিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ার কথা, তা এখানে অনুপস্থিত ছিল। আর এতে অরিত্রী ও তার পরিবারের জীবনে ঘটে গেল এক অনভিপ্রেত ট্র্যাজেডি।

পরীক্ষা ও একমাত্র নম্বরভিত্তিক সাফল্যের ওপর নির্ভরশীল ব্যবস্থায় অভিভাবকেরা যেমন, তেমনি শিক্ষকও শিক্ষার্থীর কাছ থেকে সব বিষয়ে একই রকম সাফল্যের জন্য চাপ দিতে থাকেন। ব্যবস্থাটাই এমন যে দেশের শিক্ষার তদারকি ও নিয়ন্ত্রক দপ্তরগুলো স্কুল, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর ভালো ফলাফলের জন্য লাগাতার চাপ দিয়ে যায়। এর ফল হিসেবে আমরা শিক্ষক-অভিভাবকদের এমনকি খোদ শিক্ষা দপ্তরের কর্মীদেরও প্রশ্নফাঁসের মতো অপরাধে জড়িত হতে দেখেছি। আবার পরীক্ষার ফল খারাপ হলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবাইকে দোষী হতে হয়। এটা একটা বড় ট্র্যাজেডি যে এ ব্যবস্থায় দুর্বলের জন্য কোনো স্থান নেই।

কথায় বলে, হোঁচট না খেলে হাঁটা শেখা হয় না। ঠিক তেমনি ভুল করার অবকাশ না থাকলে মানুষেরও যথার্থ শিক্ষা লাভ হয় না। স্কুলগুলো সাফল্যের দৌড়ে শিশুর বিকাশের এ সহজ সত্য অস্বীকার করছে। মুশকিল হলো সেই স্কুলগুলোই সমাজে বিখ্যাত হিসেবে গণ্য হচ্ছে, যেগুলো শিক্ষার্থীদের ভুলের বা ব্যর্থতার জায়গা রাখছে না।

এ সূত্রে মনে পড়ছে, ইতালির একটি স্কুলের ফেল করা ছাত্রদের লেখা একটি বইয়ের কথা। বাংলায় বইটির নাম আপনাকে বলছি, স্যার। কী বলছে তারা? তারা বলছে, আমরা কেউ গণিতে, কেউ ল্যাটিনে, কেউ ব্যাকরণে ফেল করায় স্কুল থেকে আমাদের তাড়িয়েছেন। তাহলে ব্যাপারটা হলো আপনারা এমন একটি হাসপাতাল চালাচ্ছেন, যেখান থেকে রোগীদের তাড়িয়ে সুস্থদের সেবা দিচ্ছেন।

বিখ্যাত স্কুলগুলো বছরব্যাপী পরীক্ষায় ছাঁকনি চালিয়ে দুর্বল শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে এবং টিসি ধরিয়ে দেয়। অর্থাৎ রুগ্ণ ছাত্রদের বাদ দিয়ে সুস্থদের নিয়ে তারা কাজ করে।

এ অবস্থায় একবারও ভাবা হয় না, একজন কিশোর বা কিশোরী কতটা সংবেদনশীল হয়, তার মান-অভিমান কতটা তীব্র থাকে। অরিত্রী যদি কোনো ভুল করে থাকে তার বিপরীতে স্কুলের সংশ্লিষ্টরা করেছেন অপরাধ। মৃত্যুর পরে দেখা যাচ্ছে, সহপাঠীরা রয়েছে কিশোরী অরিত্রীর পাশে। আর তার জীবনের এই ট্র্যাজেডির প্রেক্ষাপটে আমরা করজোড়ে দেশের শিক্ষা বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের বলব, শিক্ষা এবং শৈশব-কৈশোরের বহুমাত্রিক বিষয়গুলো একটু গভীরভাবে বিবেচনায় নিতে হবে।

ভাবতে হবে স্কুলের কাজ কী—পরীক্ষা নেওয়া নাকি শিক্ষা দেওয়া। আমরা বলব, দুটোই। তবে মূল কাজ হলো শিক্ষাদান। ছাত্রের শেখা কেমন হলো, মান কেমন তা বোঝার জন্য পরীক্ষা বা মূল্যায়ন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, শৈশব হলো জ্ঞান আহরণ ও সঞ্চয়নের কাল। ফল ধরবে পরে। অর্থাৎ শিশু-কিশোরেরা জ্ঞান ও জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য শৈশবে প্রস্তুতি নেবে। বলা যায়, প্রাথমিকে প্রস্তুতি ভালো হলে হাইস্কুলে যেতে যেতে শিক্ষার্থী হিসেবে তারা সবল হয়ে উঠবে।

অরিত্রী আমাদের ব্যবস্থার ভিকটিম। এই ব্যবস্থায় সবাই মিলে তার কাছে যে ফল চেয়েছেন, হয়তো তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। হয়তো বাস্তবতার চাপে সে মরিয়া হয়ে ভুল কিছু করেছে আর যখন দেখল সেই ভুলের মাশুল বিকট রূপ ধারণ করে তার ওপরে আছড়ে পড়েছে, তাকে রক্ষার কেউ নেই। তখন ওই ছোট মানুষটি কোনো পথের দিশা পায়নি। এমনকি তার পিতা–মাতার ক্ষমাভিক্ষাও যখন অগ্রাহ্য হয়, তখন সেই সমাজ বা পৃথিবীর কাছ থেকে একরত্তি মেয়েটি আর কী আশা করতে পারে। ওই মুহূর্তে তার মনের আকাশের সব প্রদীপ দপ করে নিভে গিয়েছিল। তার সব আশা ও ভবিষ্যতের ওপর নেমে এসেছিল যবনিকা।

মেয়েটি চুলে ফুল গুঁজে ছবি তুলেছিল। সে হাসিমুখ এখন তার বাবা-মায়ের মনে চিরস্থায়ী বেদনার ছবি হয়ে থাকবে। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভুল ও অন্যায়ের প্রতিবাদ হয়ে ফুটে থাকবে।

আবুল মোমেন: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক