গুম-সভায় কান্না

প্রিয়জন গুম বা অপহরণের শিকার হওয়া ৩০টির বেশি পরিবারের সদস্যরা ৪ ডিসেম্বর রাজধানীতে মিলিত হয়ে আবারও অঝোর ধারায় কেঁদেছেন। তঁাদের কারও কান্নাই নতুন কোনো খবর নয়। বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের যুগে পদ্ধতিগতভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং বিচ্ছিন্নভাবে গুম বা অপহরণ চালু হয়েছিল। তাদের ক্ষমতাত্যাগ–পরবর্তী এক দশকে দুঃখজনকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে সরকারযন্ত্র পদ্ধতিগত খুনের সঙ্গে গুমকেও হাতিয়ারে পরিণত করেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এবং ভুক্তভোগীরা এর প্রতিকার দাবি করে আসছে। দেশি–বিদেশি প্রভাবশালী মানবাধিকার সংস্থাগুলো এসব বিষয়ে অব্যাহতভাবে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে ন্যূনতম জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। আমরা বুঝতে পারি, এ বিষয়ে একটি অলিখিত দায়মুক্তি ভোগ করে চলেছে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কুশীলবেরা। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক, ভীতিকর এবং চূড়ান্ত বিচারে তা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব হতে বাধ্য।

আমরা স্মরণ করতে পারি, গোড়ার দিকে কুখ্যাত অপরাধী যঁারা ফেরারি, প্রধানত তঁারাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ফেরারি আসামিদের জামিন লাভ এবং বিচারহীনতাকেও দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা ব্যক্তিগত শত্রুতাবশত রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহারের বিষয় সামনে এসেছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন তারই একটি বড় উদাহরণ।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকা এবং দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলে হঠাৎ করেই গুম বেড়ে যায়। এতে পরিস্থিতির একটি স্থায়ী অবনতি ঘটে। কারণ, প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরে সরকারি সংস্থার তরফে একটি বিবৃতি পাওয়া যেত। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো লাশ ফিরে পেত। কিন্তু গুমের ধারা চালু হওয়ার পরে এ অবস্থার একটি পরিবর্তন আসে। আমরা বুঝতে পারি, সরকারি রীতি মেনে প্রতিটি খুনের ঘটনায় একটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু তার ফল প্রকাশ করা এবং তার ফলাফল জানতে আমজনতার মধ্যে কোনো আগ্রহ নেই।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে কী অঙ্গীকার করেছিল এবং গত এক দশকে এ ক্ষেত্রে কী কী ঘটেছে, সেসব বিষয়ে দেশবাসী এখন তাদের কাছে উপযুক্ত কৈফিয়ত আশা করে।

সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান বিরোধী দল, যারা দাবি করছে যে তাদের প্রতি বিপুল জনসমর্থন রয়েছে এবং অবাধ ভোট হলে তাদের পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব হবে, তারা গুমের বিষয়ে পলায়নপর থাকতে পারে না। গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা একটি সংবেদনশীল সময়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনে সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের এ আকুতির প্রতি অব্যাহত নির্লিপ্ততা প্রত্যাশিত নয়। আশা করব, সরকার গুম হওয়া মানুষগুলোর হদিস জানতে দ্রুতই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেবে। তারা নিজেরাই জড়িত নয়, এটা গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গে প্রমাণ করে দেওয়ার কোনো সদুত্তর নয়। কারণ, সব পরিস্থিতিতে সব ধরনের নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের মৌলিক দায়িত্ব।

গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ছোট–বড় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত এগিয়ে আসা। এসব প্রতিরোধে দলগুলোর উচিত নিজ নিজ অবস্থান ও বক্তব্য নির্বাচনী ইশতেহারগুলোতে সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা। বিএনপি অপারেশন ক্লিন হার্ট বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করলে সেটা সরকারের ওপর চাপ তৈরিতে কাজে লাগতে পারে।

আমরা মনে করি, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন এবং নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদানের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে তা সরকারযন্ত্রকে অধিকতর দায়িত্বশীল করে তুলতে সহায়ক হতে পারে।