এরশাদ একটি সিনড্রোম

৬ ডিসেম্বর দিনটি আমাদের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। একাত্তরের ওই দিন ভারত সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজেই লোকসভার অধিবেশনে উপস্থিত হয়ে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। এর ১৯ বছর পর ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর সামরিক একনায়ক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন। ২৭ বছর ধরে দিনটি ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ হিসেবে গণমাধ্যমে শিরোনাম হলেও রাজনীতির মাঠে এ নিয়ে উচ্ছ্বাসে যে ভাটা পড়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

দুনিয়ার অন্য কোথায় কী হয়, তার সব খবর আমার জানা নেই। তবে আমি মোটামুটি নিশ্চিত, আমাদের মহাদেশে গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারিয়ে রাজনীতিতে আবারও পুনর্বাসিত হওয়া এবং প্রবল বিক্রমে ‘আলো ছড়ানোর’ আর কোনো উদাহরণ কোনো সামরিক শাসক দিতে পারেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এটি তাঁর কৃতিত্ব, নাকি এ জাতির লজ্জা, তা নিয়ে আলোচনা হতেই থাকবে।

এ দেশে অনেকেই এরশাদের ভক্ত। তাঁর একটি রাজনৈতিক দল আছে—জাতীয় পার্টি। দেশে কয়েকটি পকেট আছে, যেখানে তাঁর দলের যথেষ্ট প্রভাব। এ ছাড়া দেশের সব জায়গায় তাঁর কমবেশি কিছু সমর্থক আছে, আছে ফ্যান। এগুলো কি এমনি এমনি হয়েছে? তাঁর কি কোনো গুণ নেই?

এরশাদ নিঃসন্দেহে একজন ‘গুণী’ মানুষ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর কথা বাদ দিলে তিনি যে সবচেয়ে ‘শিক্ষিত’ সরকারপ্রধান ছিলেন, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তাঁর কথাবার্তা মার্জিত, রুচিশীল। তিনি দাঁত, মুখ খিঁচিয়ে কথা বলেন না। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শব্দচয়নে যথেষ্ট সাবধানী। তাঁর একটি কবিমন আছে। পান্থপথ, প্রগতি সরণি, বিজয় সরণি, রোকেয়া সরণি, চন্দ্রিমা উদ্যান, পথকলি—এই সুন্দর শব্দাবলি তাঁর মাথা থেকেই এসেছে। বিলাতি বিকৃত উচ্চারণ থেকে রাজধানী ‘ঢাকা’ পুনরুদ্ধারের কৃতিত্বও তাঁকে দিতে হয়। পত্রিকার পাতায় ‘শামসুর রাহমান মনোনীত কবিতা’ শিরোনাম দিয়ে কবি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কবিতা ছাপা হয়েছে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল কবি-লেখকদের সম্মিলনী, যেখানে সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে ইমরান নূর (মনযুরুল করিম), সৈয়দ আলী আহসান থেকে ফজল শাহাবুদ্দীন—সবাই যোগ দিতেন। কিন্তু ছাত্রসমাজ তাঁকে স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। ছাত্ররা তাঁর আরামের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। ১৯৮৩, ১৯৮৭ ও ১৯৯০-এর ছাত্রবিক্ষোভ এবং গণ-আন্দোলনে তাঁর ক্ষমতার আসনটি নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। শেষমেশ তাঁর ক্ষমতার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছেন সেনাবাহিনীর একদল তরুণ কর্মকর্তা, যাঁরা তাঁর স্বেচ্ছাচারের দায় নিতে অস্বীকার করেছিলেন। তাঁদের হয়ে চিফ অব জেনারেল স্টাফ আবদুস সালাম এরশাদকে চূড়ান্ত বার্তাটি দিয়েছিলেন—এখন যাওয়ার সময় হয়েছে।

জেনারেল এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন ৪ ডিসেম্বর রাতে। রাজনীতির লাগাম তখন তিন জোটের হাতে। তাদের ঐকমত্যের সূত্র ধরে ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে তাঁর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। ৯০ দিনের মধ্যে একটি নির্বাচন দিয়ে তিনি পুরোনো চাকরিতে ফিরে যান।

তখন মনে হয়েছিল এরশাদের রাজনীতি বুঝি শেষ—খেল খতম। এরশাদ নিশ্চয়ই মনে মনে হেসে বলেছিলেন—তুমি থাকো ডালে ডালে, আমি হাঁটি পাতায় পাতায়। আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে এরশাদ এখনো প্রাসঙ্গিক। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে তিনি একজন পাকা খেলোয়াড়, এখনো গোল দিয়ে যাচ্ছেন, ছক্কা হাঁকছেন। এটা কেমন করে সম্ভব হলো? সম্ভব হয়েছে রাজনীতিবিদদের কারণেই। সবাই ম্যাকিয়াভেলিকে দেবতাজ্ঞানে পূজা দেয়। এ জন্যই রাজনীতির বাজারে এরশাদের দাম এখনো চড়া।

অনির্বাচিত সরকার নিয়ে আমাদের শুচিবাই আছে। বুট পায়ে, রাইফেল হাতে জোর কদমে ক্ষমতার অন্দরমহলে ঢুকে পড়া উর্দিধারীদের ‘অসাংবিধানিক’ বলে আমরা এককথায় যতই উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি না কেন, আমাদের কাছ থেকেই তারা রাজনৈতিক বৈধতা পেয়ে যায়। ইশপের নীতিকথা তখন শিকেয় তোলা থাকে। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থান এ দেশে বৈধতা পেয়েছিল। কারণ, ওই সময় আওয়ামী লীগ তথা বাকশাল ছাড়া বাকি সবাই তাকে স্বাগত জানিয়েছিল, অথবা খুশি হয়েছিল, অথবা মেনে নিয়েছিল। সামরিক আইনের আওতায় ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সংসদে তাদের সঙ্গে ছিল স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ আর ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ। হয়তো ওটাই ছিল বাস্তবতা।

১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ যখন বিএনপির সাত্তার সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা নেন, তখন বিরোধীরা প্রায় সবাই হাততালি দিয়েছিলেন। এমনকি বিএনপির একটি বড় অংশ এতে যোগ দিয়েছিল। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো নিজস্ব প্রতীক নিয়ে অংশ নিয়েছিল। ওই সংসদে তাদের সঙ্গে আরও ছিল আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মোজাফফর), সিপিবি, জাসদ (রব)। ফলে এরশাদ এবং জামায়াতে ইসলামী যুগপৎ রাজনৈতিক বৈধতা পেয়ে যায়।

সাত্তার সরকারের ক্ষমতাবৃত্ত থেকে ছিটকে পড়া এবং এরশাদের ক্ষমতা দখলে বিএনপির প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ খুশি হয়েছিল। তারা মনে করেছিল, তাদের প্রধান শত্রু বিএনপি তো গেল, এটাই লাভ। রাজনীতির হাটে নেতা বেচাকেনার ব্যাপারে এরশাদ ছিলেন একজন পাকা ফড়িয়া। বিভিন্ন দলের অনেক নেতাকে তিনি ডিগবাজি খাওয়ালেন। কেউ কেউ তাঁর মধ্যে একজন যুগান্তকারী দার্শনিকের সন্ধান পেয়েছিলেন।

১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। এরশাদকে পাঁচ বছর জেলে রেখেও বিএনপি তাঁর সঙ্গে আঁতাত করে আওয়ামী লীগকে বিরোধী দলে রাখতে চেয়েছিল। এরশাদকে প্যারোলে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। বাগড়া দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তখন থেকেই এরশাদকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রশি টানাটানি চলছে। এটা বুঝতে পেরেই এরশাদ নির্বাচন এলেই নিলামে চড়ান নিজেকে, সুবিধামতো দরদাম হাঁকেন। তাঁর আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার পছন্দের স্থান হলো সিএমএইচ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদ কেবল একজন ব্যক্তি বা নেতা নন, তিনি একটি সিনড্রোম বা উপসর্গ। ‘স্বৈরাচার’ শব্দটি তিনি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তিনি আলাদা করে চালু করেন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়। ওটি এখনো বহাল আছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হিসেবে। এটি এখন ক্ষমতার দরবার শরিফ।

একনায়কেরা সব দেশেই আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চান। কিন্তু এ তো অসম্ভব। দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের সময় তারা সংবিধানে একটি ধারা বসিয়ে দিয়েছে—কেউ এক মেয়াদের বেশি সরকারপ্রধান থাকতে পারবেন না। ফিলিপাইনে মার্কোসের পতনের পর কোরাজন একিনের সরকার একই ধারা ঢুকিয়েছে সংবিধানে। ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো সরকারের পতন হলে ওই দেশের সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়—সরকারপ্রধান দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না। আমাদের দেশে এটি এখনো আলোচনায় আছে। তবে কাজের কাজ হয়নি। ফলে দীর্ঘমেয়াদি শাসনের শর্ত তৈরি হয়েছে।

এরশাদ মাঝেমধ্যে বলে থাকেন, ‘আমি আর এমন কী স্বৈরাচার!’ কথাটি ফেলে দেওয়ার মতো নয়। গণমাধ্যমে এ ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করতে পারেন। তিনি তো কবি। তো রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ করে তিনি তো বলতেই পারেন:
আম্র কহে, একদিন, হে মাকাল ভাই,
আছিনু বনের মধ্যে সমান সবাই;
মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি—
মূল্যভেদ শুরু হল, সাম্য গেল ঘুচি।

এরশাদ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির প্রতীক ও প্রতিভূ। তাঁকে মুখে মুখে বাতিল করে দিলেও তাঁর প্রেসক্রিপশন বাতিল হয়নি।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]