বিচারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে

আমাদের দেশে বিচারব্যবস্থা বা বিচার বিভাগ নিয়ে যত আলোচনা, তার প্রায় সবটাই উচ্চ আদালতের আলোচনায় শেষ হয়। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে বিচার সংস্কৃতির দুর্বলতা, সাধারণ মানুষের আদালতের দরজা পর্যন্ত পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বাধাবিঘ্ন, বিচারপ্রার্থীর দুর্ভোগ, দীর্ঘসূত্রতা, ব্যয়বহুলতা, আইনি সহায়তা প্রদান ও গ্রহণের অসুবিধা ইত্যাদি মিলিয়ে দরিদ্র মানুষের জন্য উচ্চ আদালতের বিষয়টি বাদ দিলেও জেলা পর্যায়ের জজকোর্টের চৌকাঠ মাড়ানোও অকল্পনীয় হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে আইন ও নির্বাহী বিভাগের প্রতিনিধিত্ব ও বিস্তার তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও বিচার বিভাগ জেলার নিচে সম্প্রসারিত নয়।

সরকারের তিনটি অঙ্গের দুটি অঙ্গ রাজধানী থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও বিচার বিভাগ জেলা পর্যন্ত এসে থেমে যায়। ১৯৮০ দশকে বিভাগীয় স্তরে হাইকোর্ট বেঞ্চ এবং দেশের সব থানা বা উপজেলা পর্যায়ে সহকারী জজের নেতৃত্বে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত গঠিত হয়েছিল। তা ছাড়া, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সহকারী কমিশনারদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া ছিল। ১৯৯১ সালে ক্ষমতার পালাবদল হলে বিভাগীয় শহরে স্থাপিত হাইকোর্ট বেঞ্চগুলো রাজধানীতে এবং উপজেলা পর্যায়ে স্থাপিত সহকারী জজদের দ্বারা পরিচালিত দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতগুলো জেলা পর্যায়ে ক্লোজ করা হয়।

উপজেলা পর্যায়ে সহকারী জজের কোর্ট ১৯৮২ সাল থেকে প্রায় সাত-আট বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেন। গ্রামের প্রান্তিক মানুষ ব্যাপকভাবে এ আদালতের সুফল পেতে শুরু করে। উপজেলায় আদালতের অবকাঠামো তথা কোর্ট ভবন, এজলাস, সাবজেল ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে নির্মিত হয়। জেলা শহর ও ঢাকার অভিজাত আইনজীবীদের বিরোধিতা ও অসন্তোষ সত্ত্বেও উপজেলা পর্যায়ে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র আইনজীবীদের চেম্বার গড়ে ওঠা শুরু হয়। আদালত বাড়ির নিকটবর্তী হওয়ায় হাজিরা বৃদ্ধি পায়। সাক্ষীসাবুদ হাজির করাও সহজসাধ্য হয়। ফলে মামলার নিষ্পত্তিও স্বাভাবিকভাবে দ্রুততর হয়।

হাসনাত আবদুল হাইয়ের নেতৃত্বে সিরডাপের অর্থায়নে কুমিল্লা একাডেমি থেকে উপজেলা পরিষদসহ আদালতের কার্যকারিতা বিষয়ে একটি সমীক্ষা করা হয়। হাসনাত আবদুল হাই আমাকেও এ গবেষণায় তাঁর সহযোগী হিসেবে যুক্ত করেন। আমরা কুমিল্লার নাঙ্গলকোট ও চান্দিনায় কেস স্টাডি করে দেখতে পাই যে প্রাথমিক অবস্থায় ১৯৮১-৮২ সালে নাঙ্গলকোট ও চান্দিনায় গড়ে ৮০০-৯০০ মামলা দায়ের বা স্থানান্তরিত হয়। এসব মামলার সবগুলো নতুন মামলা ছিল না। মহকুমা ও জেলা আদালত থেকে সংশ্লিষ্ট উপজেলার পেন্ডিং মামলাগুলো উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সহকারী জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে বেশির ভাগ মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যায়।

উপজেলা আদালতের কারণে, বিশেষ করে প্রান্তিক অঞ্চলের অভিযোগকারী নারীরা অধিক উপকৃত হন। বিশেষত, বিবাহবিচ্ছেদ ও খোরপোশের মামলাগুলোর নিষ্পত্তি সহজে হয়ে যায়। গ্রামাঞ্চলে থানায় অনেক সময় সাধারণের মামলা সহজে গ্রহণ করা হয় না। কোর্ট কাছে থাকায় থানা সতর্ক থাকত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে থানা মামলা গ্রহণ না করলে মানুষ সরাসরি আদালতের শরণাপন্ন হতে পারত। তা ছাড়া, ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যরত গ্রাম আদালতও উপজেলায় আদালত থাকার কারণে সতর্কতার সঙ্গে তাঁদের কাছে দায়েরকৃত মামলাগুলো দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি করতেন। গ্রামাঞ্চলে পুলিশ-আদালত-প্রশাসন-সালিসের ব্যবস্থার মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষিত হচ্ছিল। পরবর্তীকালে ১৯৮৯-৯০ সালের দিকে বিষয়টি নিয়ে আবার আমি কুমিল্লার অন্য একটি উপজেলা বুড়িচং ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে উপজেলা আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করি এবং প্রায় একই রকমের একটি চিত্র দেখতে পাই।

বর্তমানে দেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে অবিশ্বাস্য মামলাজট। বলা হয়, দেশের বিভিন্ন আদালতে ৩০ লাখের অধিক মামলা বিচারাধীন। সুবিচার নিশ্চিত করতে হলে প্রতিষ্ঠিত প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায় না। তাই হয়তো প্রয়োজন আদালত ও বিচারকের যৌক্তিক সংখ্যা বৃদ্ধি। জনভোগান্তি হ্রাস করার জন্য প্রয়োজন নিম্ন আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ। এ জন্য আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশের প্রতিটি উপজেলায় সহকারী জজ নিয়োগ করে সেখানে পূর্ণাঙ্গ ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালত স্থাপিত হোক। আগে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের মালিকানায় যে আদালত ভবন ও সাবজেল নির্মাণ করা হয়, তার নিয়ন্ত্রণ আবার গ্রহণ করা হোক। কর্মরত সিনিয়র সহকারী জজদের পদায়ন করে কিছু কিছু উপজেলায় আদালত চালু হোক। এ সময়ের মধ্যে পরিকল্পনামাফিক সহকারী জজ নিয়োগ ও তাঁদের প্রশিক্ষণ হতে থাকুক।

দেশের মানুষ শেষ পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ আদালত দেখতে চায়। একটি উপজেলায় গড়ে তিন-চার লাখের বেশি লোকের বাস। এত লোকের জন্য কোনো বিচারক ও বিচারালয় নেই। ফলে বিচারের নামে যা হচ্ছে, তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ‘গ্রাম আদালত’ নামক যে ব্যবস্থাটির একটি দুর্বল আইনগত বৈধতা দেওয়া হয়েছে, সেটি কোনোভাবে আদালত হিসেবে গণ্য হতে পারে না। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করা এক ব্যক্তি যেকোনো স্তরে কোনো আদালত পরিচালনা করতে পারেন না।

অপরদিকে গ্রামীণ বাংলাদেশে বিচারালয়ের শূন্যতায় থানার পুলিশ ব্যাপকভাবে থানায় বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। চট্টগ্রাম এলাকার কয়েকটি থানায় পর্যবেক্ষণ করে সেখানে রাতের বেলায় জমিজমার বিরোধসংক্রান্ত একাধিক দরবার দেখা যায়। থানা জমি মাপজোখের আমিনও নিয়োগ দিয়ে থাকে। দিনে মাপজোখ হয়, রাতে থানা প্রাঙ্গণে দরবার বসে। এ রকম বিচারব্যবস্থার একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। বিষয়টি সবাই জানে, কিন্তু কেউই কিছু বলছে না। একাডেমিক গবেষকেরা এসব বিষয়ে বরাবরই গাফেল। প্রশাসকেরাও নীরব।

উপজেলা এখন যোগাযোগসহ সব দিক থেকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত সুন্দর বসবাস উপযোগী এলাকা। অন্যান্য বিভাগের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা উপজেলায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। দুজন সহকারী জজ এখন স্বচ্ছন্দে উপজেলায় বসবাস করতে পারবেন। দেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর শত শত ছাত্রছাত্রী আইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছেন। তাই উপযুক্ত বিচারক নিয়োগ এবং উপজেলায় আইনজীবী পেতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। প্রয়োজন শুধু একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার। আইন মন্ত্রণালয় ও দেশের প্রধান বিচারপতি সম্মত হলে উপজেলা পর্যায়ে নিম্ন আদালত সম্প্রসারিত হতে পারে।

দেশ এখন নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে। রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকে নির্বাচনী ইশতেহার রচনায় নিয়োজিত। ইশতেহারে অনেকে হয়তো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা লিখবেন। দেশের সব দেশপ্রেমিক দল ও জোটগুলোর প্রতি আবেদন, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য নিম্ন আদালত সম্প্রসারণ করে উপজেলা পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ আদালত স্থাপনের অঙ্গীকার করুন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ উপজেলা পর্যায়ে আদালত চালু
করেছিলেন, তিনি এত বছর ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে থাকলেন অথচ তিনিও কখনো এ বিষয়টি সংসদে আলোচনায় আনলেন না। আশা করি, এবারের নির্বাচনে উপজেলায় আদালত স্থাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে আসবে। নির্বাচনের পরে যে সরকার গঠিত হবে, তারা বিষয়টি বাস্তবায়নে আন্তরিক হবে। উপজেলা পর্যায়ে আদালতের সম্প্রসারণ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

ড. তোফায়েল আহমেদ: রাজনীতি ও লোকপ্রশাসনের অধ্যাপক, স্থানীয় সরকার ও শাসন বিশেষজ্ঞ
tofail 101 @gmail. com