তাবলিগের গৃহবিবাদের ভার সইতে পারব তো?

আলেম সমাজের সহনশীলতার ওপর পরিস্থিতির পরিণতি নির্ভর করছে। ছবি: প্রথম আলো
আলেম সমাজের সহনশীলতার ওপর পরিস্থিতির পরিণতি নির্ভর করছে। ছবি: প্রথম আলো

বছরের এই সময় তাবলিগের ইজতেমায় অংশ নিতে বিপুল মানুষ টঙ্গীতে আসেন। অনেকের দরিদ্রের কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মযাত্রা। অর্থাভাবে পবিত্র মক্কা-মদিনায় যেতে না পেরে তাঁরা টঙ্গীতে এসে আরও লাখো মুসল্লির সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে কান্নাকাটি করেন; আত্মশুদ্ধির ছবক নেন। এই ধর্মীয় ঐতিহ্যের ৫০ বছর পূর্তি হয়ে গেছে। ফলে এই জমায়েত বাংলাদেশের একরূপ আমানত। কিন্তু এবার একই মৌসুমে বেমানান দৃশ্য দেখা যাচ্ছে ইজতেমা ঘিরে। তাবলিগ সংগঠকেরা একাংশ অপরাংশের ফাঁসির দাবিতে পোস্টার লাগাচ্ছেন এই মুহূর্তে। রাজধানী ছাড়িয়ে ‘তৌহিদি জনতা’র নামে প্রচারিত এ রকম পোস্টার পড়ছে সদূর গ্রামেও। কেবল পোস্টারই নয়, জামাতের দুই পক্ষ মাদ্রাসায় মাদ্রাসায়, গ্রামে গ্রামে পরস্পরকে শনাক্ত করছে। পরস্পরের দ্বীনি কাজে বাধা দিচ্ছেন। জেলায় জেলায় বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভকে ঘিরে সংঘর্ষও হচ্ছে।

প্রচার জগতেও সংঘাতের ছাপ পড়েছে। পরস্পরের বিরুদ্ধে ইসলামি বিভিন্ন অনলাইনে তীব্র আক্রমণ চলছে। অজ্ঞাত উসকানিতে মজলুমদের বিরুদ্ধে মজলুমদের দাঁড় করানো হচ্ছে। জানুয়ারি থেকে ইজতেমার প্রথম পর্ব হওয়ার কথা থাকলেও তা কতটা সুষ্ঠুভাবে হবে সে নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ মুসল্লিরা। পারস্পরিক বিভাদের মধ্যে সাধারণের আমল কীভাবে আল্লাহর দরবারে পৌঁছাবে, সেটাই এখন প্রশ্ন।

মতবিভেদ দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে, সংঘাত কেবল বাংলাদেশে! এই বিরোধের শুরু ভারতে, তাবলিগের কেন্দ্রীয় সংগঠকদের মাঝে ধর্মীয় দাওয়াতের স্বরূপ এবং জামাতের নেতৃত্ব নিয়ে মতদ্বৈততা থেকে। যার রেশ ধরে বাংলাদেশের চলতি সংঘাত। ক্রমে তাতে বহু সামাজিক-রাজনৈতিক উপাদান যুক্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশে তাবলিগের বিবদমান দুটি ধারা পরস্পরকে চিহ্নিত করছে ‘জেনারেল’ ও ‘মাদ্রাসাভিত্তিক’ ধারা হিসেবে। একপক্ষে মাদ্রাসার আলেমদের আধিক্য, অন্যধারায় চিকিৎসক-প্রকৌশলী-বিশ্ববিদ্যালয়–পড়ুয়ারা বেশি। তৃতীয় পক্ষের অতি উৎসাহী ব্যাখ্যাকারীরা আবার দুই ধারাকে ‘ভারতপন্থী’ বনাম ‘পাকিস্তানপন্থী’ হিসেবেও চিহ্নিত করছে। বাস্তবে যা দেখা যাচ্ছে, কওমি আলেমরা চাইছেন তাবলিগে তাঁদের মতামতের বিশেষ গুরুত্ব থাকুক।

তাবলিগ জামাতের মূলকেন্দ্র দক্ষিণ দিল্লির ‘নিজামুদ্দিন মারকাজ’। পাকিস্তানের মারকাজ লাহোরে রায়ভেন্ডে। বাংলাদেশ মারকাজ ঢাকার কাকরাইল মসজিদে। দিল্লিকেন্দ্রে যিনি প্রধান, তিনিই বিশ্ব-তাবলিগের ‘আমির’। সে হিসেবে বর্তমানে এই দায়িত্বে আছেন মাওলানা সা’দ কান্ধলভী। তাঁর কিছু বক্তব্য নিয়ে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের ভিন্নমত আছে। এরই জের বাংলাদেশের সর্বশেষ রক্তপাত, বিরোধ, ফাঁসির দাবি, ইজতেমা নিয়ে অনিশ্চয়তা।

তাবলিগি দাওয়াতের পূর্বতন মুরব্বি হজরত ইলিয়াস শাহ রহ. (১৯২৪-১৯৪৫), হযরত ইউসুফ রহ. (১৯৪৫-১৯৬৫), হজরত এনামুল হাসান (১৯৬৫-১৯৯৫) পর্যন্ত দাওয়াত পরিচালনায় কোনো মতবিরোধ কথা জানা যায় না। এদের পরই কেন্দ্রে বিরোধের সৃষ্টি।

এনামুল হাসান মারা যাওয়ার আগে তাবলিগের কাজ পরিচালনার জন্য ১০ সদস্যের শুরা গঠন করে দেন। তাতে ভারতের পাঁচ, পাকিস্তানের চার এবং বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি (আবদুল মুকিত) ছিলেন। ২০১৪-১৫ নাগাদ এই ১০ জনের আটজন মারা যান। বেঁচে থাকা দুজনের মধ্যে সা’দ কান্ধলভী হলেন হজরত ইলিয়াসের প্রপৌত্র এবং ইউসুফ কান্ধলভীর নাতি। ‘খান্দানের প্রতিনিধি’ হিসেবে তাঁর তাবলিগে বাড়তি প্রভাব ছিল। সা’দ মনে করছেন ‘দ্বীনের দাওয়াত কেবল মসজিদভিত্তিক’ হওয়া উচিত। দেওবন্দ মনে করেছে, এতে ‘দ্বীনের অন্যান্য শাখাকে হেয় করা’ হয়। বিবাদের এ রকম তালিকা বেশ দীর্ঘ। নিজামুদ্দীন মারকাজের সঙ্গে দেওবন্দের দূরত্বের ছাপ পড়েছে গত দুই তিন বছর ধরে বাংলাদেশের তাবলিগে এবং আলেম-ওলামাদের মধ্যেও।

২০১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া উপরিউক্ত ভিন্নমতের পরও ভারতে এ নিয়ে কোনো সংঘাত হয়নি। দেওবন্দের আলেমরা কাউকে ‘প্রতিরোধ’-এ নামেননি। সে রকম আলামতও নেই। বাংলাদেশেও গত বছর পর্যন্ত নিরাপত্তার সঙ্গেই ইজতেমা হয়েছে। সরকার দায়িত্বের সঙ্গে ইজতেমার আয়োজনে সহায়তা দিয়েছে।

তবে ২০১৭-এর নভেম্বর থেকে কাকরাইলে বিরোধ প্রকাশ পাচ্ছিল। মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর ঢাকা আগমনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে আলেম সমাজের একাংশ। দেওবন্দের অনুসারী মনে হয়েছে তাদের। এই বিক্ষোভকারীরা ঐতিহাসিকভাবে তাবলিগের মূল সঞ্চালকশক্তি নন কিন্তু দেওবন্দের সঙ্গে সা’দের বিরোধের কারণেই মনে করছেন ‘একজনের কারণে লাখ লাখ মানুষকে গোমরাহির শিকার’ হতে দেওয়া যায় না। মূলত কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক নেতৃস্থানীয় আলেমদের মধ্যে সাদ কান্ধলভীর বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে। তারই রেশ ধরে, জুলাইয়ে কওমি নেতাদের একাংশ এ দেশে মাওলানা সা’দপন্থীদের সঙ্গে বিভক্তিকে আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। কাকরাইল মারকাজের পুরোনো শুরা সদস্যরাও পাঁচজন করে দুই ধারায় বিভক্ত এখন। এভাবেই বাংলাদেশের তাবলিগি আন্দোলন ভেঙে দুই ধারা হয়ে গেছে বলা যায়। ১ ডিসেম্বর যার রক্তাক্ত অভিপ্রকাশ দেখা গেল। সেদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে আক্রমণকারীরা কীভাবে এত তাণ্ডব দেখাতে পারল, সেটা বিশাল রহস্য। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে মনে হচ্ছে, ৭০ বছর বয়সী ইসমাইল মণ্ডলের মৃত্যুতে বিবাদমান কোনো পক্ষ অনুতপ্ত নয়। মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি বলছে আলেম সমাজ সতর্ক না হলে এই বিবাদ আরও বাড়বে।

ফৌজদারি অপরাধ রাজনৈতিক পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে থাকা সংগত
টঙ্গীতে মূল ইজতেমা পিছিয়ে দেওয়ার পরও কাদের দ্বারা সেখানে ১ ডিসেম্বর মাদ্রাসা ছাত্ররা জড়ো হলো এবং কাদের ইঙ্গিতে অন্যরা তাদের তাড়াতে গিয়েছে সেটা সরকার ইচ্ছা করলেই বের করতে পারে। করা উচিতও। ফৌজদারি অপরাধ রাজনৈতিক পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে থাকাই সংগত। কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যেই উভয় পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করছে; কিন্তু তাতে উত্তেজনার বিস্তৃতি থামছে না। অথচ সংঘাত রুখতে সরকার কতটা সক্রিয় সেই বিষয়ে আশ্বস্ত হতে চায় দূরগ্রামের মুসল্লিরা এখনি।

ভারতে দেওবন্দ এই বিবাদে মাওলানা সাদের বিপক্ষে ফেতনাবিরোধী ফতোয়া দিলেও যেকোনো ধরনের সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি এড়িয়ে গেছে। এরূপ ভূমিকা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশে উল্টোটি কেন হচ্ছে সেটা অনুসন্ধান দাবি করে।

দেশব্যাপী নির্বাচনের প্রচারণার কারণে এই বিবাদে ‘সমাজ’-এর অংশগ্রহণ আপাতত কম। কিন্তু যেটা উদ্বেগের তাহলো, ইজতেমার সময় ঘনিয়ে আসামাত্র অজ্ঞাত উৎস থেকে ধীরে ধীরে সংঘাত গ্রাম পর্যন্ত যাচ্ছে। ইজতেমা স্থগিত বলা হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেই। বিবাদমান উভয় পক্ষ প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার চেষ্টায় আছে। জাতীয় রাজনীতির আশপাশে থেকে নানা কর্মকাণ্ডে ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত এসব নেতাদের কারও কারও কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার বাসনা এই সংঘাতকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। তাবলিগের কর্তৃত্ব হাতে থাকা না-থাকার মধ্যে রাষ্ট্র প্রক্রিয়ায় প্রভাবের বিষয় রয়েছে। আবার ভারতে বিরোধ না মিটলে বাংলাদেশে বিবাদের সুরাহা কঠিন। সরকার চাইলেও এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সমাধান দিতে পারবে বলে মনে হয় না। এরূপ দ্বিমুখী টানাপোড়েনে কে মরছে,কারা মার খাচ্ছে, কারা ফাঁসির আওয়াজ তুলছে, কিছুই সাধারণের কাছে স্পষ্ট নয়। অবিলম্বে এই বিদ্বেষ ও রক্তপাত থামানো দরকার থাকলেও কয়েকজন ব্যক্তির ভূমিকা সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলছে না। ভাগাভাগির প্রক্রিয়ায় মাদ্রাসাগুলোকে শামিল করতে চলছে উত্তেজক বয়ান। ফলে শেষবিচারে আলেম সমাজের সহনশীলতার ওপর পরিস্থিতির পরিণতি নির্ভর করছে।

সরকারের বাইরে বিরোধী রাজনৈতিক দল এমনকি ইসলামি দল হিসেবে পরিচিতরাও এ বিষয়ে নীরব। ‘জনপ্রিয়তা হারানো’র ভয়ে কেউই মুখ খুলছেন না। প্রচারমাধ্যম জনতুষ্টিবাদে আক্রান্ত। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সত্য ও শুভ ভাবনাকে নিখোঁজ মনে হচ্ছে। সংঘর্ষের ছবি তুলতে গেলে মুসল্লিদের একাংশ সাংবাদিকদের ক্যামেরা তুরাগ নদীতে ফেলে দিয়ে তারই যেন প্রতীকী ইঙ্গিত দিলেন।

সমাজ নতুন বিভেদের ভার বইতে অক্ষম
শঙ্কা রয়েছে তাবলিগের এই সংঘাত বাংলাদেশে নতুন গৃহবিবাদ তৈরি করবে। দেশজুড়ে এমন পাড়া-মহাল্লা-গ্রাম নেই যেখানে তাবলিগের কেউ নেই। ফলে সবচেয়ে জরুরি দুই পক্ষের সালিস ও সহাবস্থান; যা সম্ভব করতে পারেন আলেম সমাজের গুরুজনেরা।
তাবলিগের এক বড় উসুল (মূলনীতি) হলো একরামুল মুসলিমিন বা মুসলমানদের সহায়তা। শান্তি, ঐক্য ও সংহতির মধ্য দিয়েই সেটা সম্ভব। বাংলাদেশের আলেম সমাজে হাফেজ্জী হুজুরের মতো দূরদর্শী নেতৃত্ব বেঁচে থাকলে হয়তো এই বিবাদ এত তিক্ত হতো না। এরপরও আশা, বর্তমান আলেমদের দূরদর্শী কেউ না কেউ বিভেদপন্থী আবেগের লাগাম টেনে ধরবেন। তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন এ দেশের সমাজ নতুন কোনো বিভেদের ভার বইতে অক্ষম।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক