সাকিবের ডাকে তরুণেরা সাড়া দেবে?

সাকিব আল হাসান
সাকিব আল হাসান

কাকতালীয়ভাবে তরুণেরা সাকিব আল হাসানের কথা রাখতে শুরু করেছেন। বলছিলাম সাকিব আল হাসানের এক ভিডিও বার্তা নিয়ে। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই ভিডিও বার্তায় বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট প্রার্থনা করেছেন। বিশেষ করে তরুণদের কাছে। আবেগঘন ওই বার্তায় সাকিব বলেছেন, ‘সবাইকে ভালো রাখা ও সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার এক দুর্বার যাত্রায় এখন আমরা আছি। বিদ্যুতে, শিক্ষায়, খাদ্যে, স্বাস্থ্যে, নারীর ক্ষমতায়নে, সামাজিক ও মানব উন্নয়নে তো বটেই, অবকাঠামো, যোগাযোগ ও ডিজিটাল উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের উদাহরণ হতে চলেছে।’ সাকিব এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ চেয়েছেন। সাকিবের এই ভিডিও বার্তা প্রচার ও প্রকাশের পরদিনই তারুণ্যের ইশতেহার প্রকাশ করেছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের তরুণ সংগঠকেরা। এ জন্যই বলছি, তরুণেরা সাকিবের কথা রাখতে শুরু করেছেন। তবে, ভিন্নভাবে।

সাকিব আল হাসানের এ উদ্যোগ একেবারে মন্দ না। দেশের কোটি তরুণের নায়ক তিনি। আমাদের সময় কিশোর, তরুণেরা ক্রিকেট খেলতেন ব্রায়ান লারা, কার্টলি এমব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশ, ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, কপিল দেব বা শচীন টেন্ডুলকারকে সামনে উদাহরণ রেখে। দিন বদলেছে। এখনকার তরুণ, কিশোরেরা মাশরাফি, সাকিব, মোস্তাফিজকে সামনে রেখে ক্রিকেটচর্চায় ব্রত হয়। এটা আমাদের জন্য বিশাল অর্জন। একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশ বিশ্বমানের দল। বাংলাদেশ ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ জয় করলে আমি অন্তত অবাক হব না। বাংলাদেশের সেই সামর্থ্য আছে। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকরা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে সাকিবের প্রচারণা ভোটারদের মনে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এটা ইতিবাচক না নেতিবাচক হবে, তা সময়ই বলে দেবে। কারণ, জাতীয় দলে থাকা অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রচারণা চালানো কতটা নৈতিক, এটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ‘ইমেজ বিল্ডিং’ বা ‘ভাবমূর্তি গঠন’ বলে একটি জিনিস পড়ানো হয়। এখানে আওয়ামী লীগ বা সাকিব আল হাসান; কে কার ভাবমূর্তি গঠন করছেন, তা তর্ক সাপেক্ষ। হতে পারে উভয়েই উইন উইন অবস্থায় আছে। মানে সাকিবের ভিডিও প্রচার করে আওয়ামী লীগ তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করল। সাকিবও এর বিনিময়ে অন্য কোনোভাবে সার্থক হলেন।

সাকিব হয়তো জেনে থাকবেন, তরুণেরা কারও ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন না। তাঁরা নিজ তাগিদেই রাষ্ট্রের নির্মাণে মাঠে নেমে পড়েন। যেমন কিশোরেরা রাষ্ট্র মেরামতে নেমেছিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়। সাকিব অবশ্য কিশোরদের আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করতে পারেননি। তাই তিনি কিশোরদের মেরামতকর্মের মধ্যপথেই সরকারি প্রেসনোটের মতো অনেক হয়েছে বলে ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। পরে আধা ঘণ্টার মধ্যেই তা মুছে ফেলেন। কিশোরেরা সাকিকের কথায় ঘরে ফিরে যায়নি। তাদের মেরামতকর্ম অব্যাহত ছিল। সাকিব কিশোরদের ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা বললেও পরবর্তী সময়ে ওই কিশোরদের কি হয়েছিল, সম্ভবত আর কোনো খোঁজ রাখেননি। রাখলে কিশোরদের ওপর হেলমেট বাহিনীর হামলা নিয়ে পরবর্তী সময়ে স্ট্যাটাস দিতেন। বলতে পারতেন, হেলমেটধারীরা অনেক হয়েছে ঘরে ফিরে যাও। রাষ্ট্রের মেরামতে স্বপ্নচারী কিশোরদের স্কুল–কলেজ থেকে টিসি দেওয়া নিয়েও কথা বলতেন।

সাকিব আল হাসান খোঁজখবর না রাখলেও বলা যেতে পারে তরুণদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবেই সাড়া মিলেছে। তারুণ্যের ইশতেহার নিয়ে তরুণেরা সাকিবের নিজের দল আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের কাছে গিয়েছেন। নিজেরা ফলাও করে সেই ইশতেহার ঘোষণাও করেছেন। তরুণদের কথা পরিষ্কার। এরা কল্যাণকামী এক সম–অধিকারের রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। যেখানে সবার সমান অধিকার থাকবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হবে। যাতে করে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আমজাদ হোসেনকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে না হয়। দেশেই তাঁর সুষ্ঠু চিকিৎসা সম্ভব হয়।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। তরুণের দল ও সাকিব আল হাসান উভয়েই দেশের উন্নয়নের সারথি হতে চান। কিন্তু তাদের মধ্যে ভাবনার ফারাক বিস্তর। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তরুণেরা বাস্তবসম্মত উন্নয়ন পরিকল্পনা চান। তরুণেরা চাকরির নিশ্চয়তা চান। বেকারত্বের অভিশাপ, ব্যবসায় লোকসানের হতাশা নিয়ে আত্মহত্যা করতে চান না। একসময় পাশের দেশ ভারতে কৃষকেরা কৃষিঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। এখনো মাঝেমধ্যে ভারতীয় কৃষকের আত্মহত্যার সংবাদ আসে। আবার আমাদের ঢাকা থেকেও আত্মহত্যার সংবাদ পাই। মহাখালী থেকে বনানী পর্যন্ত রেলপথ নাকি আত্মহত্যার পথে পরিণত হয়েছে। হতাশা ও অভিমান নিয়ে এ পথে গিয়ে অনেক তরুণই আর ফিরে আসেন না। সাম্প্রতিক সময়ে এই অংশটুকুতে আত্মহননের হার বেড়ে গেছে। চাকরি না পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীও আত্মহত্যা করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তরুণেরা জনদাবি নিয়ে রাজপথে নামতে চান না। কারণ তাঁরা মনে করেন, পথে নামার আগেই রাষ্ট্র তাদের দাবি পূরণ করবে বা পথে নামলেও হেলমেট বাহিনী থেকে রক্ষা করবে।

এই কিশোর তরুণদের চাওয়া দেশে গুম, খুন, জখম, ধর্ষণ কমে আসবে। স্কুল–কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের নির্মমভাবে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হাড় ভেঙে দেওয়া হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার সোনাকে মিশ্র ধাতুতে পরিণত করার অভিযোগ উঠবে না। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হতে হবে না। হল–মার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো ব্যাংক লুটেরাদের বিচার করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ সহিসালামতেই থাকবে। রিজার্ভ চুরির তদন্তের নামে টাকা খরচ করে তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করে ফেলে রাখা হবে না। গণপরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নাগালের মধ্যেই থাকবে। রাজনীতিবিদদের হলফনামায় মিথ্যা তথ্য থাকবে না। রাজনীতিবিদেরা স্ত্রীদের ওপর নির্ভরশীল হবেন না। নিজেরাই উপার্জনের পথে নামবেন। তরুণদের জন্যও উপার্জনের পথ তৈরি করবেন।

তরুণদের সমস্যাগুলো সাকিবের বক্তব্যে পাওয়া যায় না। সাকিব আল হাসান সরলীকরণ করে উন্নয়নের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সাকিব উন্নয়নের যে সূচকগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন, এসবের উন্নতি সব সরকারের আমলেই হয়ে থাকে কমবেশি। প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষাজীবন শেষে যদি চাকরি, জীবিকার নিশ্চয়তা না থাকে, তবে এসব কথিত উন্নয়নের সুযোগ তো তরুণেরা নিতে পারবেন না। কিন্তু এ তরুণেরাই এবারের নির্বাচনের গতিপথ বদলে দিতে পারে।

নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুসারে দেশে মোট ভোটারের সংখ্যা ১০ কোটি ৪১ লাখ। এর মধ্যে গত ১০ বছরে নতুন ভোটার হয়েছে ২ কোটি ১৫ লাখ। এই নতুন ভোটারের বয়স ১৮ থেকে ২৮। তরুণ ভোটাররাই এবারের নির্বাচনে বিজয়ের নিয়ামক হতে পারে। সাকিব আল হাসান তাঁর দলের ভোট বাড়াতে এই তরুণদের লক্ষ্য করেছেন। নিজের ইমেজকে ব্যবহার করে তরুণদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। তবে সাকিবের প্রচারণায় আছে অর্জনের গল্প। সন্দেহ নেই, অর্জন অবশ্যই কৃতিত্বের। কিন্তু সেই সঙ্গে যে সামনের স্বপ্নটাও রাখতে হয়। ৮০ বছরের বৃদ্ধ নিজের অর্জন নিয়ে সুখ রোমন্থন করেন। কিন্তু ১৮ বছরের তরুণের চোখে থাকে অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্ন। তরুণদের যৌক্তিক পরিকল্পনা করে বাস্তবসম্মত স্বপ্ন দিয়ে আকৃষ্ট করতে হয়। পেছনের অতীত দিয়ে কাছে টানা যায় না। বরং কিছু কিছু অতীত দিয়ে দূরেও ঠেলে দেয়। কারণ, ভোটকেন্দ্রে তরুণদের চোখে যদি হাতুড়ি বাহিনী, হেলমেট বাহিনীসহ নানা বাহিনীর চিত্র ওঠে, তবে তা সুখকর হবে না। তরুণেরা নিশ্চয়ই এসব কথা ভুলে যায়নি। কোটা আন্দোলনের নেতাদের রিমান্ডের কথাও তরুণেরা সব মনে রাখে।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন