পার্বত্য চুক্তি

পার্বত্য চট্টগ্রামের চুক্তি বাস্তবায়নের প্রধান বাধাগুলো অবিলম্বে দূর হওয়া উচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের চুক্তি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটি অসাধারণ অর্জন হিসেবে গণ্য হয়েছিল। কিন্তু গত ২১ বছরে চুক্তি বাস্তবায়নে যে অগ্রগতি ঘটেছে, সেটা সন্তোষজনক অবস্থা থেকে অনেক দূরে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতা নির্দেশ করছে যে পাহাড়ের মানুষের জীবনে নিরাপত্তাহীনতা গভীর হতে পারে।

আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ ও পার্বত্য ভূমি কমিশনকে কার্যকর করার ওপর পাহাড়িদের জীবনে শান্তি নেমে আসার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আইনে তাদের যত ক্ষমতা দেওয়া আছে, তা তারা কার্যকর করতে পারছে না। কারণ, বিধিমালা করা হয়নি। সে কারণে সন্তু লারমা অনেক সময় দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার কোনো ক্ষমতা নেই। পাহাড়িদের জীবনে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো পার্বত্য ভূমির ন্যায্য বণ্টন। কিন্তু গত ২১ বছরে এটিই সব থেকে বেশি উপেক্ষিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার তিন বছর পর ২০০১ সালে প্রথম ভূমি কমিশন আইন প্রণীত হয়। কিন্তু সেই আইনে গুরুতর গলদ ছিল। এরপরে বিএনপি-জামায়াত জোটের পাঁচ বছরে কোনো অগ্রগতি হয়নি। তারা আইনে ত্রুটি জানার পরেও নীরব থেকেছে।’

আমরা মনে করি, ভূমিবিরোধ নিরসন প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় পলায়নপরতা রয়েছে। আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে প্রধান দলগুলো তাদের ইশতেহারে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটাতে পারে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, আমরা এ পর্যন্ত তার কোনো লক্ষণ দেখছি না। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের কৃতিত্ব আওয়ামী লীগ সরকারের হলেও চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে তাদের অনীহার বিষয়টি স্পষ্ট। অন্যদিকে সরকারের নিন্দায় মুখর থাকা বিএনপি কখনো পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কথা মুখে নেয় না। 

আসলে দলনির্বিশেষে ওই পলায়নপরতা থেকে দূর হতেই হবে। এটা না পারলে শুধু আইন সংশোধন করে যে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না, ইতিমধ্যে তারও প্রমাণ তৈরি হয়েছে। কারণ, ২০১৬ সালে প্রত্যাশিত সংশোধনী আনা হলেও সেই আইন বাস্তবায়নের পথে কোনো অগ্রগতি নেই। গত দুই বছরে অগ্রগতি বলতে এটাই যে আইনটি সংশোধিত হয়েছে এবং সেই সংশোধিত আইনের আওতায় প্রথমবারের মতো পার্বত্য নেতারা কমিশন সভায় অংশ নিয়েছেন। কিন্তু সেই সভায় অংশগ্রহণের কোনো অর্থ বহন করে না। কারণ হচ্ছে পার্বত্য ভূমি কমিশনের পরিচালনার জন্য যে বিধিমালা হওয়া দরকার, সেটা প্রণীত হয়নি।

পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন নিয়ে যে পরিমাণ সন্তুষ্টি এবং কৃতিত্ব দাবি করা হয়, তার সঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় যে এতটা আকাশ-পাতাল তফাত হতে পারে, সেটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব বিষয় দীর্ঘকাল হেলাফেলায় ফেলে রাখা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মধ্যে অসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকবে। এই মনোভাব সার্বিক বিচারে জাতীয় নিরাপত্তার ধারণার সঙ্গে খাপ খায় না। সম্পাদিত শান্তিচুক্তির যদি কোনো আইনগত বৈধতার বিষয় থেকে থাকে, তাহলে সেটা আদালতের মাধ্যমে নিশ্চয় নিষ্পত্তি করতে হবে।

কিন্তু আদালতের দোহাই দিয়ে এই চুক্তি বাস্তবায়নের পথে সরকারের তরফে অনেক ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা থাকার দাবি করা হয়, তা ভিত্তিহীন বলে প্রতীয়মান হয়। চুক্তি বাস্তবায়নের সময়সূচিভিত্তিক রোডম্যাপ দিতে হবে। পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন, ভূমি, বন, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ক ক্ষমতা আঞ্চলিক পরিষদের কাছে এখনো ন্যস্ত করা হয়নি। আবার স্বাস্থ্য, শিক্ষা—এ রকম কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে। সংবিধান বিভিন্ন জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীর যে মর্যাদা দিয়েছে, কিন্তু তা যে কাগুজে নয়, তা প্রমাণ করার দায় সরকারের।