মুক্তির জন্য অপরিহার্য গুণাবলি

সফল ও সার্থক মানবজীবন মানে হলো দুনিয়াতে শান্তি ও পরকালে মুক্তি নিশ্চিত হওয়া। শান্তি ও মুক্তির একমাত্র সহজ, সরল, সঠিক ও নিশ্চিত পথ হলো ইসলাম। এই সফলতা লাভের জন্য অপরিহার্য গুণাবলি বা শর্তগুলো হলো: বিশ্বাস, সৎকর্ম, সত্য সদুপদেশ অনুসরণ, ধৈর্য সহায়তা প্রদান ও অনুশীলন। আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে বলেন, ‘সময়ের শপথ! মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে; তবে তারা ছাড়া যারা ইমান এনেছে ও সত্কাজ করেছে এবং একজন অন্যজনকে হক কথার ও সবর করার উপদেশ দিয়েছে।’ (সুরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১,২ ও ৩)।

এ সুরায় সময়ের শপথ করে বলা হয়েছে, সব মানুষ ক্ষতির মধ্যেই রয়েছে, এই ক্ষতি থেকে একমাত্র তারাই রক্ষা পেয়েছে, যারা চারটি গুণাবলির অধিকারী। যথা: ইমান বা বিশ্বাস, আমলে সালেহ বা সত্কাজ, পরস্পরকে হক বা সত্যের উপদেশ প্রদান এবং একে অন্যকে সবর বা ধৈর্য ধারণের উপদেশ দান।

‘বিশ্বাস হলো সব কর্মকাণ্ডের মূল চালিকা শক্তি, সময় হলো জীবনের মূলধন, সত্য হলো একমাত্র যথাযথ অবলম্বন, ধৈর্য হলো সফলতার সোপান। যাদের মধ্যে এই চারটি গুণাবলির সমাবেশ ঘটেছে, তারাই সমূহ ক্ষতি ও ধ্বংস হতে রক্ষা পেয়েছে এবং ইহকাল ও পরকালে সফল হয়েছে।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৩৭; সুরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ৫৪; সুরা-৮ আনফাল, আয়াত: ২০ ও ২৭; সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ৩৮; সুরা-৬১ সফ, আয়াত: ২)।

বিশ্বাস করা অর্থ সত্য গ্রহণ করা। কোরআন কারিমের ভাষায়, ‘মোমিন (বিশ্বাস) তো আসলে তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ইমান আনে আর তারপর সংশয়ে লিপ্ত হয় না।’ (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৫)। ‘যারা বলে আল্লাহ আমাদের রব, আর তারপর তার ওপর অবিচল থাকে।’ (সুরা-৩২ হা-মিম সাজদা, আয়াত: ৩০)। ‘আসলে তারাই মোমিন বা প্রকৃত বিশ্বাসী, আল্লাহর কথা উচ্চারিত হলে যাদের অন্তর কেঁপে ওঠে।’ (সুরা-৮ আনফাল, আয়াত: ২)। ‘যারা ইমান এনেছে, তারা আল্লাহকে সর্বাধিক ও অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ভালোবাসে। কাজেই, না (হে নবী! সা.) আপনার রবের কসম! তারা কখনোই মোমিন নয়, যতক্ষণ না তাদের পারস্পরিক বিরোধে আপনাকে ফয়সালাকারী হিসেবে না মেনে নেয়। তারপর যা কিছু আপনি ফয়সালা করে দেন, সে ব্যাপারে তারা মনে কোনো প্রকার সংকীর্ণতা অনুভব করে না; বরং মনেপ্রাণে তা মেনে নেয়।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ৬৫)।

নিম্নোক্ত আয়াতে ইমান তথা বিশ্বাসের মৌখিক স্বীকারোক্তি ও প্রকৃত ইমানের তথা অন্তরের বিশ্বাসের পার্থক্য আরও বেশি স্পষ্ট করে প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, আসল লক্ষ্য হচ্ছে প্রকৃত ইমান, মৌখিক স্বীকারোক্তি নয়, ‘হে ইমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ইমান আনো।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৩৬। মানুষ ইমানের দাবি সত্ত্বেও যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশিত পথ ছেড়ে অন্য পথে চলে তখন আসলে সে নিজেই তার এ দাবির বিরোধিতা করে।

মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচার জন্য দ্বিতীয় যে গুণটি অপরিহার্য প্রয়োজন সেটি হচ্ছে, ইমান আনার পর সত্কাজ করা। সৎকাজ ছাড়া শুধু ইমান মানুষকে সম্পূর্ণ ক্ষতির হাত থেকে পরিপূর্ণ রক্ষা করতে পারে না। বিশ্বাসের গুণটি ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে থাকতে হবে। অবশিষ্ট গুণগুলো সামগ্রিক ক্ষতি অমঙ্গল ও অকল্যাণ থেকে বাঁচার জন্য একান্ত জরুরি। তা হচ্ছে সৎকর্ম, সদুপদেশ ও ধৈর্য তথা সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতা। যারা ইমান আনে ও সত্কাজ করে তাদের পরস্পরকে হক কথা বলার ও হক কাজ তথা ন্যায় কর্ম করার এবং ধৈর্যের পথ অবলম্বন করার উপদেশ দিতে হবে। এই সুন্দর সমাজব্যবস্থা যাতে বিনষ্ট না হয়, সে জন্য সমাজের প্রতিটি নাগরিককে সচেতন থাকতে হবে।

‘সৎকাজের আদেশ করা এবং অসত্কাজ থেকে বিরত রাখা সব মোমিন মুসলিমের দায়িত্ব ও কর্তব্য।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১০৪)। ‘সেই উম্মতকে সর্বোত্তম উম্মত বলা হয়েছে, যারা এই দায়িত্ব পালন করে।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)। হকের নসিহত করার সঙ্গে দ্বিতীয় যে জিনিসটিকে ইমানদারের ও তাদের সমাজের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য অপরিহার্য শর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে তা হলো, সমাজের সব নাগরিক পরস্পরকে সবর করার উপদেশ দিতে থাকবে। যত দিন এই হকের উপদেশ অব্যাহত থাকবে, তত দিন এ সমাজে কল্যাণ ও সৃজনশীলতার প্রাণশক্তি সদা প্রবাহিত থাকবে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail, com