ক্ষুব্ধ এরশাদ, নীরব রওশন এবং রাজনীতির অসুখ

এরশাদের নির্বাচনকালীন অসুস্থতা একেবারে শারীরিক নয়, রাজনৈতিক অসুখও বটে।
এরশাদের নির্বাচনকালীন অসুস্থতা একেবারে শারীরিক নয়, রাজনৈতিক অসুখও বটে।

সাবেক স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে এখন নানা ধরনের নাটক হচ্ছে। সেই নাটকের এক দৃশ্যে দেখা গেল এরশাদ হঠাৎ করেই হাসপাতালে ভর্তি হলেন। চিকিৎসা নিলেন।

আরেক দৃশ্যে আমরা দেখতে পেলাম তিনি হাসপাতাল থেকেই তাঁর মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে সেই পদে বসিয়েছেন মসিউর রহমান রাঙ্গাকে। কয়েক বছর আগে একই কায়দায় জিয়াউদ্দিন বাবলুকে সরিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারকে বসিয়েছিলেন। হাওলাদারের বিরুদ্ধে মনোনয়ন নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন তাঁরই দলের অনেক নেতা। টিভিতে একজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর আক্ষেপ শুনলাম, ‘আমি ৬০ লাখ টাকা দিয়েছি, তারপরও আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।’ তবে অভিযোগ আছে, মনোনয়ন পেতে এখন কোনো বড় দলেই ৬০ লাখ টাকা দিলে হয় না। কোটি কোটি টাকা দিতে হয়। মনোনয়ন নিয়ে সব দলেই চাপানউতর আছে। কিন্তু জাতীয় পার্টির মতো দলের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে অভিযোগ আনেননি, অফিসের সামনে ব্যানার নিয়ে ক্ষোভ দেখাননি।

জাতীয় পার্টিতে মহাসচিব পরিবর্তন হলেও মনোনয়ন–সংকট কাটেনি। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা শুধু আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জে ফেলেনি। সংকটে ফেলেছে জাতীয় পার্টিকেও। বিএনপি নির্বাচনে না এলে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর–কষাকষি করে অনেক বেশি আসন বাগিয়ে নিতে পারত। কেননা ২০১৪ সালে তারা আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে প্রমাণ দিয়েছে। জাতীয় পার্টি না এলে ওই নির্বাচনের নৈতিক না হলেও যে আইনি বৈধতা এসেছে, তা–ও সম্ভব হতো না। আর আওয়ামী লীগ আসন বণ্টনে রাজি না হলে জাতীয় পার্টি নিজেই ৩০০ আসনে নির্বাচন করত। কিন্তু এবার বিএনপি সব গড়বড় করে দিয়েছে।

প্রথমে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের কাছে এক শ আসন চেয়েছিল। আওয়ামী লীগ নীরব। এরপর এক শ থেকে নেমে ৮০ আসন চাইলেও আওয়ামী লীগ সাড়া দেয়নি। এরপর ৮০ থেকে ৬০, ৫০, ৪০–এরও নিচে নেমে এসেছে তাদের চাওয়া। শুক্রবার সহযোগী একটি পত্রিকা রিপোর্ট করেছে, আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে শেষ পর্যন্ত ৩৬টি ও যুক্তফ্রন্টকে ৩টি আসন ছেড়ে দিয়েছে। এরশাদের পক্ষে এটি মানা কঠিন এ কারণে যে, জাতীয় পার্টির অনেক সাংসদও বাদ পড়বেন। এটাই এরশাদের অসুখের আরেক কারণ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

যখনই নির্বাচন ঘনিয়ে আসে, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে ভর্তি হন। কখনো তিনি ভর্তি না হতে চাইলেও ‘অদৃশ্য হাত’ তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসে। ২০১৪ সালে এরশাদ যখন বললেন, বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন হবে না, তখনই তাঁর রাজনৈতিক অসুখ দেখা দিল। এরপর সিএমএইচে ভর্তি করা হলো। নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর তিনিও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন।

সেই নির্বাচন হয়েছে পাঁচ বছর আগে। পাঁচ বছর পরও প্রায় একই ধরনের নাটক হলো। হাসপাতাল থেকে সরাসরি বনানীতে তাঁর রাজনৈতিক অফিসে এসে এরশাদ বললেন, ‘আমার বয়স হয়েছে। চিকিৎসা করতে দেবে না। বাইরে যেতে দেবে না। আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। আমাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না।’ কে তাঁকে দমিয়ে রাখতে চায়, সে কথা বলেননি। তাঁর কণ্ঠে ক্ষোভ ছিল। অন্যদিকে সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ একেবারে চুপ। একটি কথাও বলছেন না।

এরশাদ একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। তিনি বিরোধী কোনো দলের নেতা নন। তাঁর দল সরকারেরও অংশীদার। আগের মহাসচিব বেসরকারি মানুষ হলেও নতুন মহাসচিব মন্ত্রিসভার সদস্য। এ অবস্থায় কে তাঁর চিকিৎসায় বাধা দিচ্ছে, কে বাইরে যেতে বাধা দিচ্ছে, সেটি পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। নিশ্চয়ই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনো নেতা তাঁর চিকিৎসায় বাধা দেননি। তাঁরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা নিয়েই ব্যস্ত আছেন।

চিকিৎসার জন্য এরশাদের বাইরে যেতে কোনো সমস্যা নেই। তবে মহাজোটের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার পরই তিনি সেটি পারবেন। তাঁর নতুন মহাসচিব মসিউর রহমানও সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এরশাদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে দলের ভেতরে–বাইরে কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করেন না। আবার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

জাতীয় পার্টি ও বিএনপির গঠনতন্ত্রটি এমনভাবে সাজানো যে দলীয়প্রধান ইচ্ছে হলে যেকোনো কমিটি থেকে যে কাউকে বাদ দিতে কিংবা কমিটিতে নিতে পারবেন। চাইলে পুরো কেন্দ্রীয় কমিটিও বাতিল করতে পারেন। আমাদের দেশের সামরিক শাসকেরা যখন দল করেন, তখন কোনো সিভিলিয়ানকে বিশ্বাস করেন না বলেই এমন গঠনতন্ত্র বানিয়েছেন। আইয়ুব, জিয়া ও এরশাদের দল একই আদলে করা।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের এবারের অসুখটি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত অসুখ নয়। এটি রাজনৈতিক অসুখও বটে। ব্যক্তিগত অসুখ চিকিৎসা করালে নিরাময় পাওয়া যায়। কিন্তু এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অনিরামেয় অসুখ নিয়ে এসেছিলেন, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চে, সেই অসুখ এখনো গোটা জাতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। জেলে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্বৈরাচারের পতন হয়নি। গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা পায়নি। স্বৈরাচারকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, হয় না। গণতন্ত্রে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদেরও ঠাঁই নেই।

দেশের হাসপাতালে না হলে বিদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে হয়তো এরশাদের রোগ নিরাময় হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে যে এরশাদ–সিনড্রোম চলছে দুই–আড়াই দশক ধরে, তা নিরাময়ের কোনো লক্ষণ দেখছি না।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]