ইশতেহারের বাস্তবায়ন চাই

ইশতেহার ঘোষণা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নির্বাচনী কৃত্যের একটি আবশ্যকীয় উপাদান। কিন্তু এই মৌসুমি চরিত্রের কারণেই কিনা, কে জানে, ইশতেহারের প্রয়োজনটাও দলগুলোর কাছে নির্বাচন-পরবর্তী মৌসুম শুরু হলেই ফুরিয়ে যায়। বিজয়ী দল তাদের ইশতেহারটি কুলুঙ্গিতে রেখে দিয়ে তাতে ধুলাবালি জমতে দেয়। তাদের কাজে ও আচরণে ইশতেহারে ঘোষিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলোর তেমন প্রতিফলন ঘটে না। আর বিরোধী দলগুলো সংসদে আসন পেলেও তাদের ইশতেহারে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না, যেহেতু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার লক্ষ্য রেখেই ইশতেহার লেখা হয়। এবারের নির্বাচন যেমন ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণমূলক হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি, যা একে আগের নির্বাচনগুলো থেকে অনেকটাই ব্যতিক্রমী করবে, ইশতেহার ঘোষণা ও পরবর্তী সময়ে একে ভুলে থাকার চর্চাতেও তাই একটা বড় পরিবর্তন আসা উচিত।

গত কয়েকটি নির্বাচনে দেশের বড় দুই দলের নির্বাচনী ইশতেহার পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি দেখেছি, ইশতেহারে একটা মোটাদাগে—যাকে আদর্শিক বলা যায়—দলগুলো তাদের বক্তব্য হাজির করে। তারপর থাকে অনেক বিষয়ে তাদের অবস্থান ও কর্মসূচি। আমরা জানি, নির্বাচনী ইশতেহার দলগুলোর আদর্শিক অবস্থান ও তাদের দর্শন ও চিন্তাসূত্রকে তুলে ধরে এবং নির্বাচনে জয়ী হলে তারা কী করবে, কীভাবে দেশের আর্থসামাজিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়ন/পরিবর্তন ঘটাবে, তা-ও নির্দিষ্ট করে। অর্থাৎ একটি ইশতেহার একটি দলের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের ছবি তুলে ধরে তা থেকে মানুষ কী আশা করতে পারে, তার একটা ধারণা দেয়। কিন্তু প্রধানত তিনটি কারণে একটি ইশতেহারের দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত হয় না, বরং একে একটি মৌসুমি চর্চা করে তোলে। তিনটি বিষয় হলো: এর বিজয়নির্ভর চরিত্র, এতে বর্ণিত ও ঘোষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলি বাস্তবায়নে কৌশল সম্পর্কে অস্পষ্টতা এবং এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কোনো সময়রেখা না থাকা।

নির্বাচন দলগুলো করে জয়ের জন্য, সে জন্য ইশতেহার লেখা হয় জয়কে মাথায় রেখে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একদল বিজয়ী হলে অন্যগুলো পরাজিত হবে। পরাজিত হলে, সংসদে আসন পেলে অথবা না পেলে দলগুলো কী করবে, তা-ও ইশতেহারে থাকা উচিত। একুশ শতকের একটি নির্বাচনে এই নতুন ভাবনারও প্রয়োজন। এ জন্য ইশতেহারে, যাকে বলে, প্ল্যান ‘এ’ ও প্ল্যান ‘বি’—দুটি পরিকল্পনাই থাকা উচিত। বিজয়ী হলে একটি, পরাজিত হলে অন্যটি।

নির্বাচনী ইশতেহারে অনেক ঘোষণা, অনেক প্রতিশ্রুতি থাকে—যেমন শিক্ষার বিস্তৃতি বা মান বাড়ানো হবে, স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া হবে অথবা বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। কিন্তু ঠিক কীভাবে, কোন কৌশলে, তা বলা হয় না। যদি কৌশলগুলো স্পষ্ট করা হয়, তাহলে মানুষ বিচার করতে পারবে কোন ইশতেহারটি বাস্তবায়নযোগ্য আর কোনটি শুধুই আশা দিয়ে দায় সারছে।

নির্বাচনে জয়ী হলে ইশতেহারে ঘোষিত লক্ষ্য-আদর্শগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটা সময়রেখা দেওয়া উচিত। এটি হতে পারে প্রথম ১০০ দিন, এক বছর, দুই-তিন-চার বছর ও পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত। যদি মানুষ জানতে পারে, দলগুলো কী করবে, কোন কৌশলে ঠিক কত দিনে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে, তাহলে তাদের পক্ষে প্রার্থী বেছে নিতে সুবিধা হয়।

এই নির্বাচনে যে দল/জোট জিতবে, তারাই দেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে ক্ষমতায় থাকবে। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তারা কী করবে, তারও সুস্পষ্ট ঘোষণা চাই। তারা কি মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে চিন্তা-কল্পনায় রেখে এগোবে, নাকি এদের বিকল্প কোনো পাঠ উপহার দেবে, এ বিষয়টিও স্পষ্ট করা চাই। আর যে দল/জোট মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে ক্ষমতায় থাকবে, সে দল/জোট কম মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্তিবুদ্ধির চর্চাকে নানা বিভ্রান্তিমূলক আইনের নিচে ফেলে খর্ব করবে, নাকি তাদের অবারিত করবে, তারও সুস্পষ্ট অঙ্গীকার চাই।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ