গণতন্ত্রের পথ দীর্ঘ, পাড়ি দিতে হবে ধীরে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিছু কৌতুকজনক পরিস্থিতি তৈরি করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অভাবনীয় চমক নিয়ে এসেছে। এর একটি হলো বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহকর্মী ও দেশের সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরাম এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী এখন এককাতারে শামিল হয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের মাঠে নেমেছে। যে ঐক্যফ্রন্টের বড় শরিক হলো বিএনপি, তার ছোট তরফের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবং নাগরিক ঐক্যের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর বক্তৃতা শেষ করেন ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে। পত্রিকায় দেখছি, দেশের শ খানেক ইসলামি দলের মধ্যে ৯০টিই যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে। তারা এ জোটে থাকলেও নিশ্চয়ই ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান মুখে আনবে না।

যুযুধান দল বা জোটের মধ্যে কথায়-স্লোগানে ব্যবধান কমে এলে তাকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা আখ্যা দেওয়া যায়। গণতন্ত্রে পরমতসহিষ্ণুতা, ভিন্নমতের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক রক্ষা, বিভিন্ন মতের সহাবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক উপাদান হলেও এ ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ ঘটছে ক্ষমতায় পৌঁছানোর কৌশল হিসেবে। পুরোনো সমাজব্যবস্থার দুটি বৈশিষ্ট্য বা অচলায়তন বহাল রেখে গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। এ দুটি হলো সামন্ত বা সামন্ত মনোভাব এবং প্রধানত ধর্মীয় বিধানের অন্ধ সংস্কারের অচলায়তন। পশ্চিমের যেসব দেশে গণতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে, বিকাশ ও চর্চা চলছে, সেসব দেশ ধর্মচর্চার, ধর্মীয় উৎসব উদ্‌যাপনের, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান-ব্রত পালনের সব অধিকার বজায় রেখেই রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় ধর্মের ব্যবহার বর্জন বা নিয়ন্ত্রণ করেছে। গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত সব নাগরিকের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য খুব জরুরি।

গণতন্ত্রে একজন নাগরিক, তাঁর ধর্ম–বর্ণ-বংশ-পেশা তথা অন্যান্য পরিচয়ের সুবাদে বাড়তি সুবিধা ভোগ করতে পারেন না। আদর্শ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব, নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই, নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন ইত্যাদি সব কাজই দলের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়ে থাকে। হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রে এবং ইদানীং বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে নির্বাচন করতে দল ও প্রার্থীর বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। তবে পশ্চিমে এই অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়া এবং তার ব্যবহার ও ব্যয় কোনো রাখঢাক করে হয় না, প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে তহবিল সংগৃহীত হয়। ব্যয়ও একইভাবে হিসাবপত্র রেখে ও দিয়েই করতে হয়।

আমি বলছি না যে সেসব দেশে কোনো অনিয়মই হয় না, সবাই ধোয়া তুলসীপাতা। না, তাদেরও অনিয়ম আছে, প্রার্থী বা ব্যক্তির কেলেঙ্কারিও কম ঘটে না। কিন্তু এসব ঘটনার জন্য দল ও ব্যক্তিকে মূল্য দিতে হয়। লিউনস্কি–কাণ্ডে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন শেষ পর্যন্ত ইমপিচমেন্ট এড়াতে পারলেও এ–সংক্রান্ত সব নোংরাই ঘাঁটা হয়েছে, কাদাও তাঁর গায়ে যথেষ্ট লেগেছে। আর ইমপিচমেন্ট থেকে অব্যাহতি যে রাষ্ট্র, সরকার, গণতন্ত্র ও সামগ্রিক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি রক্ষার বৃহত্তর বিবেচনার ফসল, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এসব উন্নত দেশের নাগরিকেরা রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন, দলীয় বা অন্য যেকোনো ক্ষুদ্র স্বার্থ ও বিবেচনাকে এ ক্ষেত্রে মুলতবি রাখা হয়। লক্ষ করতে বলব, স্বাধীন গণমাধ্যমের গৌরবগীতে অভ্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রের সব পত্রপত্রিকাই ইরাক যুদ্ধের সময় সৈন্যসংলগ্ন সাংবাদিকতা বা এমবেডেড জার্নালিজম নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। এর অর্থ দাঁড়ায়, আক্রমণকারী বাহিনীর বরাত দিয়ে তাদেরই চোখে দেখা সংবাদ পরিবেশনে আপত্তি করেনি।

বিপরীতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন স্বাধীন সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে জিহাদ চালিয়েছেন, তখন তাঁকে কেবল গণমাধ্যম নয়, ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টির সদস্যসহ গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন দায়িত্বশীল সব মহলই নিন্দা জানাতে ভুল করছে না। মনে রাখতে হবে, তারাসহ মার্কিন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক রঙ্গমঞ্চের লোকজন তাঁর ভাঁড়ামো, খামখেয়ালিপনা, আত্মম্ভরিতা ইত্যাদি লক্ষ করছেন এবং নির্বিচারে সহ্য না করে তাঁকে নানাভাবে জানাচ্ছেন তাঁদের অসন্তুষ্টি এবং তাঁর জন্য অপেক্ষমাণ সম্ভাব্য বিরূপ পরিণতির কথা।

বাঙালি যে হুজুগে জাতি, এটি বাঙালির চেয়ে ভালো আর কে জানে। হুজুগের মাতামাতি কেটে গেলে অবশ্য দেখা যায়, যে বিষয় নিয়ে সবাই মেতে উঠেছিল, সে বিষয়ে আমাদের আন্তরিকতা, তা গভীরভাবে বোঝা, চর্চা করা ও বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই। প্রায়ই পরবর্তী কোনো হুজুগের জোয়ারে বিপরীত স্রোতে গা ভাসাতেও বিন্দুমাত্র দেরি হয় না। দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলা ভাষার কথা বলা যায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের আবেগ থেকেই বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। তারই জেরে মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ হলো স্বাধীন। কিন্তু সেই বাংলাদেশে বাংলা ভাষা আজ দুয়োরানি হয়ে ইংরেজির রমরমা চলছে। কথা হলো, পরিবর্তিত বাস্তবতায় শৈশবকাল থেকে বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষাই গুরুত্বের সঙ্গে শেখার একটা চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এসেছে। সরকার ও সমাজ এ আলোচনায় আগ্রহী নয়। একদল তড়িঘড়ি নিরঙ্কুশ ইংরেজি মাধ্যমকে সাফল্যের মার্গ ভাবল। এ ব্যবস্থায় মাতৃভাষায় দুর্বলতার ফলে শিশুর ঐতিহ্যগত স্বকীয় সংস্কৃতির গোড়াপত্তন হবে না।

বিপরীতভাবে একই ঘটনা চলছে মাদ্রাসায়। ইংরেজি ও ধর্মশিক্ষাকে বজায় রেখেও কীভাবে আমাদের উপযুক্ত শিক্ষাক্রম তৈরি হতে পারে, রাষ্ট্র ও সমাজ সেই আলোচনায় ও সমাধানে গেল না। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে কেবল নৈরাজ্য চলছে তা নয়, সারা দেশে সাংস্কৃতিক সংকট গভীর হচ্ছে এবং তারুণ্যের একটি বড় অংশ পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ছে। কেবল দেশে জনসংখ্যার সিংহভাগ তরুণ বলে ভবিষ্যৎ আমাদের এমন গালভরা আত্মবিশ্বাসের গীত গাইলেই কোনো সুফল আপনি আসবে না। কথা হলো, তরুণদের যথার্থ বিকাশের উপযুক্ত ইনপুট কি দেওয়া হচ্ছে? তাদের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য, গোলমাল রেখে ভালো আউটপুট আশা করা বৃথা।

একইভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন ও যথার্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পেতে হলে কিছু সুনির্দিষ্ট ইনপুট তো আবশ্যিক। আমাদের দেশের মানুষ মার্কা দেখে ভোট দেয়, হুজুগ উঠলে কলাগাছকেও জেতায়। এই মনোভাবের হয়তো বাস্তব ভিত্তি আছে, কিন্তু এটা তো কোনো ভালো অবস্থা নয়, গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার অনুকূল নয়। গণতন্ত্রের পথটা দুস্তর, প্রথম আলোতেই সাক্ষাৎকারে এ কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন জার্মান রাষ্ট্রদূত। কিন্তু এগোতে হলে, অভীষ্ট ফল পেতে হলে, গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার একটি রোডম্যাপ রাজনৈতিক দলগুলোকেই তো তৈরি করতে হবে। সবাই বা যে দলগুলো সরকার গঠনের সামর্থ্য রাখে, তাদের অন্তত সহমত হয়ে কিছু কাজ এগিয়ে নিতেই হবে। নয়তো গণতন্ত্রের অভিযাত্রা সংঘাতমুক্ত থাকবে না, যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশেই এ অবস্থায় পৌঁছাতে প্রচুর রক্ত ঝরাতে হয়েছে, জাতিকে দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধে জড়াতে হয়েছে।

আমার মনে হয়, অনেক বাধাবিপত্তি, বারবার হোঁচট খাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ যেমন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে চমৎকারভাবে এগোচ্ছে, তেমনি রাজনৈতিকভাবেও এগোনোর সুযোগ রয়েছে। এ জন্য নাগরিক সমাজকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাল দিয়ে হুজুগে না মেতে দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে নাগরিক সমাজের ভূমিকা ছাড়া কোনো পরিবর্তনই সম্ভব নয়। অতীতে খালেদা জিয়াকে কারাবন্দী বা তারেক জিয়াকে বাইরে রেখে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল অভাবনীয়। কিন্তু পরিবর্তিত বাস্তবতায় তারা তা করছে। প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিলে ব্যাপক ভোটারের উপস্থিতি ঘটবে আর তাতে আজ্ঞাবহ কোনো কর্মকর্তার পক্ষেও অন্য মেকানিজম প্রয়োগ সহজসাধ্য হবে না। এতে কালোটাকা ও বিভিন্ন বাহিনীর কার্যকারিতা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রিত হবে।

তবে আমাদের বড় দুর্বলতা হলো নাগরিক সমাজের বৃহত্তর অংশও হুজুগপ্রবণ, চিন্তাশীলতা ও যুক্তিবাদিতায় দুর্বলতার কারণে তারাও খোলা চোখ, খোলা মনে কথা বলতে চায় না, পারে না। এর মধ্যেও এ নির্বাচন মোটামুটি গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হলে সেটা হবে এক ধাপ অগ্রগতি। তারপর নতুন সরকারকে পথ দেখাতে হবে, যাতে শিক্ষা ও রাজনৈতিক চর্চায় সমাজ ক্রমে বহু মতকে নিয়ে চলতে শেখে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ে। গণতন্ত্র হলো সমাজের কপাট খোলার পদ্ধতি, গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে সমাজের সংস্কার ও নবায়নের যাত্রাপথ—এ অবস্থায় ব্যক্তি ও সমাজ সচল থাকে, বিকশিত হয়। আমাদের সমাজমানস আমাদেরই অজ্ঞাতে বুড়িয়ে যাচ্ছে, সেকেলে বা তামাদি হয়ে পড়ছে। নানা প্রযুক্তি ব্যবহারের বা উপার্জনের দক্ষতা আলগা স্মার্টনেস জোগাতে পারে, কিন্তু আসল ক্ষেত্রে দুর্বলতা কাটাতে পারবে না। এর জন্য মোটাদাগে একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অপরিহার্য। সেটি দীর্ঘ যাত্রা, কিন্তু যাত্রাটা শুরু হওয়া এবং সচল থাকা দরকার। সচল রাখার জন্য সংবিধান অনুযায়ী নিয়মিত নির্বাচনও প্রয়োজন। বিএনপিকে ধন্যবাদ যে তারা কোনো একটা অজুহাতে জেদ ধরে এ যাত্রাটা বানচালে নামেনি এবার।

আবুল মোমেন, কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক