কুড়িগ্রাম এবং ধুকে চলা মফস্বল

বাংলায় মফস্বলের পতন শুরু হয় ইংরেজ আমলে। পৃথিবীর তাঁতঘর বলে একদা খ্যাত বাংলা পলাশীর যুদ্ধের ৫ বছরের মাথায় ভারতের দরিদ্রতম অঞ্চলে পরিণত হয়। আমাদের Town বা মফস্বলগুলো আরও শখানেক বছর টিকে থাকে। এ ঘটনাটি স্পষ্ট হওয়া যাবে সুশীল চৌধুরীর ‘সমুদ্রবাণিজ্যের প্রেক্ষিতে স্থলবাণিজ্য’ গ্রন্থের এই উক্তি থেকে: ‘অথচ অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগেও কোম্পানিগুলোর কর্মচারীরা ইউরোপে তাদের কর্তৃপক্ষকে বারবার লিখে পাঠাচ্ছে যে, বাংলার কাপড় ও রেশমের বাজারে তারা কোনো পাত্তাই পাচ্ছে না—এশীয়/ভারতীয় বণিকরাই এসব পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।’ এই সব কারণে মফস্বলগুলো ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত পুরো ভারত ইংরেজের দখলে না আসা পর্যন্ত টিকে ছিল। আমাদের আলোচনায় সেই সব City নয়, বাংলাদেশের দরিদ্রতম Town বা মফস্বল কুড়িগ্রামকে নিয়ে।

১৯০১, ১৯১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলা প্রদেশের মধ্যে সর্বাধিক অভিবাসীর আগমন ঘটেছে সেদিনের রংপুরে। গেজেটিয়ারগুলো জানাচ্ছে, রংপুরের মধ্যে আবার কুড়িগ্রামে সবচেয়ে বেশি এটি ঘটেছে। কারণ মুঘল আমল থেকেই চিলমারী জাহাজ নির্মাণ ও পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য বিখ্যাত নদীবন্দর ছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে কুড়িগ্রামের মতো শহরগুলোর জনসংখ্যা কমে যাওয়াসহ অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারাতে শুরু করল কেন?

উত্তরে এটা বলা যায়, কলকাতাসহ লন্ডন, ম্যানচেস্টারের মতো নগরগুলো যেভাবে বাংলা অঞ্চলের প্রধান নগরগুলোর ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে উঠল, ঠিক একই প্রক্রিয়ায় স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকাসহ বাকি সিটিগুলো গড়ে উঠল এই সব মফস্বলকে শুষে নিয়ে। পরাধীন আমল ও স্বাধীন বাংলাদেশে যেভাবে কেন্দ্রীভূত বা প্রাইমেট পদ্ধতির শহর গড়ে উঠেছিল, তার বদলে ব্রিটিশ–পূর্ব যুগে বাংলায় গড়ে উঠেছিল উৎপাদন, যোগাযোগ ও ভূ-প্রকৃতিভিত্তিক শহর। ফলে মহানগর ও মফস্বল শহরের মধ্যে একধরনের জৈবিক সম্পর্ক ছিল। মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, পুণ্ড্র নগরের মতো শহর ছাড়াও ৪০-৫০টি বিখ্যাত মফস্বল শহরের কথা বলা যায়। যেমন চিলমারী ও বর্ধমানের কালনার মতো শহরগুলো ছিল নদীবন্দর ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পকেন্দ্রিক। একটি শহর হয়ে ওঠার জন্য যেসব উপাদান—যেমন যোগাযোগব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, আইনি প্রতিষ্ঠান, শিল্প-বাণিজ্য ও সংস্কৃতির বহুমুখিনতা; তা এই সব শহরের ছিল।

২.
কুড়িগ্রাম জেলায়ও এ রকম কয়েকটি বিখ্যাত শহর ছিল। চিলমারী নদীবন্দর, সোনাহাট, মোগলবাসা ও বাহারবন্দ পরগনা অন্যতম। পরে রেলপথ আসার পর লালমনিরহাট বাংলা-আসামের রেল সদর দপ্তর হিসেবে শহরে পরিণত হয়। কিন্তু কুড়িগ্রাম মধ্যিখানে হওয়ায় ও রেলসংযোগ থাকায় ধরলা নদীর পাড়ে পাকিস্তান আমলে মহুকুমা শহরের মর্যাদা পায়। একটি শহর গড়ে ওঠার জন্য পশ্চাদ্‌ভূমি হিসেবে যে যোগাযোগের বিন্দুগুলো থাকে, সেগুলো যদি অকার্যকর বা শুকিয়ে মরে, তখন মূল শহরটিও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। চিলমারী নদীবন্দর ও সোনাহাট স্থলবন্দর অকার্যকর হওয়া, রৌমারী, রাজীবপুর, ফুলবাড়ী ও রাজারহাটের সঙ্গে অন্য জেলার তুলনামূলক সহজ যোগাযোগের কারণে প্রায় বিচ্ছিন্ন হওয়ায় কুড়িগ্রাম নামমাত্র প্রশাসনিক জেলা হিসেবে টিকে আছে। তারপর কৃষি ছাড়া আর কোনো কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র না থাকায়, বাংলাদেশে যেখানে গড় দারিদ্র্যের হার ২৪ শতাংশ, সেখানে কুড়িগ্রামে ৭১ শতাংশ। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা-স্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠান না থাকায় বহুমুখী সংস্কৃতি ও চিন্তাচর্চার পরিবেশ নেই। সৃষ্টি হচ্ছে না দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তক, রাজনীতিবিদ। থাকার মধ্যে আছে কোর্ট-কাচারি আর পৌরসভা। মাঝখানে ধরলা নদীর তীরে পুরোনো কুড়িগ্রাম স্টেশন পর্যন্ত যে রেললাইন ছিল, তা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে সোনাহাট স্থলবন্দর থেকে পাথর ও কয়লা আমদানি-রপ্তানি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। পুরোনো কুড়িগ্রাম তাই এখন ভূতের ময়দান।

৩.
কালের যাত্রার ধ্বনি মেনে যেটুকু শহর হিসেবে হতে পারত, তা–ও হয়ে ওঠেনি কুড়িগ্রাম। ইয়ান গেল নামের একজন ডেনিশ স্থাপত্যশিল্পী তাঁর ‘লাইফ বিটুইন বিল্ডিংস’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, কীভাবে স্থানভেদে যোগাযোগের সম্ভাবনা, পূর্বপরিচয় রক্ষার সুযোগ, সামাজিক পরিবেশগত তথ্য, অনুপ্রেরণার উৎস, উৎসাহব্যঞ্জক অভিজ্ঞতা, কার্যকলাপের আকর্ষণ, পথচারীদের চলাচলে আকর্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে শহরবাসীর সম্পর্ক নির্মাণ হয়। তিনি অবকাঠামোর প্রভাবে যোগাযোগের সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ারও ৫টি কারণ দেখিয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে—দেয়াল, অধিক দূরত্ব, উচ্চগতি, বহুতল ও বিপরীতমুখিতা।

কুড়িগ্রাম শহরে যে টাউন হলটি তৈরি করা হয়েছে, এমন জায়গায় যার সামনে পৌরসভা মার্কেট নির্মাণ করেছে, ফলে রাস্তা থেকে টাউন হলটি দেখা যায়, তার গেটটিও মূল রাস্তায় নয় একটি গলিতে। অন্যদিকে সরকারি গণগ্রন্থাগারটি দেয়াল দিয়ে টাউন হল থেকে আলাদা। অথচ টাউন হল থেকে গ্রন্থাগার হয়ে পিটিআইয়ের গেট পর্যন্ত দৈর্ঘ্যে পৌনে এক কিমি ও প্রস্থে ৫০ গজ জায়গা রয়েছে, পুরো জায়গাতে সংস্কৃতিচর্চাসহ এক মনোরম বৃক্ষশোভিত গণ–এলাকায় পরিণত করা যায়। একটি শহরের গণ–এলাকার ওপর নির্ভর করে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক কার্যক্রম কতটুকু সংগঠিত হবে। পৃথিবীর তাবৎ শিল্প-সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে এই সব গণ–এলাকাতেই। তাই কুড়িগ্রামে এখন সংস্কৃতির চর্চা নেই বললেই চলে। কুড়িগ্রাম তাই হাঁটছে গ্রামের পথে। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়: পান্থ ম্লান চিতার কবলে/ একে-একে ডুবে যায় দেশ জাতির সংসার।

লেখক: সভাপতি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।
[email protected]